কলকাতা, 31 মার্চ: সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে ৷ ভরদুপুরে ব্যস্ত সময় ৷ অফিস-কাছারি, ব্যবসা, দোকান-বাজার সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট তিলোত্তমার ব্যবসাপাড়া ৷ ব্রিজের তলা দিয়ে গাড়ি, বাস, ট্যাক্সি চলছে ৷ মানুষও রাস্তা পেরিয়ে এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে ৷ হঠাৎই তাল কাটল ৷ দুপুরের সব ব্যস্ততা, শহরের সব কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তে ৷ "ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে", চিৎকারে মুখর হল গোটা এলাকা ৷ আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু ৷ দিনটা ছিল 2016 সালের 31 মার্চ ৷ গিরিশ পার্ক থেকে পোস্তা পর্যন্ত নির্মীয়মান বিবেকানন্দ ফ্লাইওভারের একটি অংশ ভেঙে পড়েছিল ৷
সাত বছর বাদে আজও সেই অভিশপ্ত ব্রিজের কথা কেউ ভুলতে পারেননি ৷ ভেঙে ফেলা হয়েছে ৷ সেদিনের দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছিল 28 জনের ৷ জখম হয়েছিলেন 80 জনেরও বেশি ৷ ব্রিজটার একটা অংশ একেবারে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ে রাস্তার উপর ৷ তলায় আটকে যায় মানুষ, গাড়ি, ট্যাক্সি ৷ অনেকেই হয়ত একটি বিশেষ ছবির কথা মনে আছে। ছবিতে দেখা গিয়েছিল, ট্যাক্সি থেকে তার চালক খানিকটা বেরিয়ে রয়েছেন ৷ তাঁর উপরে ট্যাক্সি, আর তার উপরে ভেঙে পড়া ব্রিজ ৷ শেষ মুহূর্তে হয়তো বেরবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি, কিন্তু পারেননি ৷ শুধু তাঁর মুখটা দেখা যাচ্ছিল ৷ পিঠের উপরে বিশাল চাপটা কখন সরবে ভাবতে ভাবতেই জীবন শেষ হয়েছিল তাঁর ৷ আজ ওই রাস্তায় উড়ালপুল নেই ৷ স্মৃতির ভাণ্ডারে বেদনারা জমে আছে শুধু।
31 মার্চের দুর্ঘটনায় পালটে গিয়েছিল রাজ্য রাজনীতি ৷ এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন রাজ্যে ৷ এদিকে এই দুর্যোগে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল ৷ জানা গিয়েছিল, ব্রিজটি তৈরিতে খুবই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে ৷ ব্রিজটি তৈরি করছিল নির্মাণ সংস্থা আইভিআরসিএল ৷ আর এর সঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট রাজ আর কাটমানির অভিযোগ তোলে বিরোধী বাম-কংগ্রেস-বিজেপি ৷ পরে উড়ালপুল নির্মাণকারী এই সংস্থা এবং কেমডিএ মিলিয়ে মোট 12 জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ ৷ বিবেকানন্দ উড়ালপুল নিয়ে স্থানীয়দের আপত্তি ছিল ৷ সরু রাস্তায় ওই বিশাল উড়ালপুল যেন দৈত্যের মতো ৷ কারও বাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে উড়ালপুলের রেলিং ৷ বহু মানুষকে ঘরছাড়াও হতে হয়েছিল সে সময় ৷ অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের স্থানীয় বিধায়ক স্মিতা বক্সির পরিবারের বিরুদ্ধেও ।
আরও পড়ুন: ফিরে আসে ভয়াল স্মৃতি, খসে পড়ে কংক্রিটের চাঁই ; ভাঙা হোক ব্রিজ চাইছে পোস্তা
এই ঘটনার পর কেন্দ্রের মোদি-সরকারের তোপের মুখে পড়ে তৃণমূলের নেতৃত্বে শাসকদল ৷ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধি ৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ও নেত্রী দীপা দাশমুন্সিও ৷ রাজ্য সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ৷ এই উড়ালপুল কেন ভাঙল ও তার অবস্থা জানতে আইআইটি খড়্গপুরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠিত হয় ৷ এই দলটি রাজ্য সরকারকে জানায় এই বিবেকানন্দ উড়ালপুলটি ভেঙে ফেলা উচিত ৷ কিন্তু এই কাজে 100 কোটি টাকা খরচ হওয়ায় সরকার দুশ্চিন্তায় পড়ে ৷
2008 সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাম সরকারের জমানায় এই বিবেকানন্দ উড়ালপুল তৈরির বিষয়টি চূড়ান্ত ছাড়পত্র পায় ৷ 2009 সালের ফেব্রুয়ারিতে 168 কোটি টাকার এই উড়ালপুল নির্মাণের কাজও শুরু হয় ৷ প্রথমে কথা ছিল, 19 মাসের মধ্যে এটি তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে ৷ কিন্তু 2016 সালের 31 মার্চ পর্যন্ত মাত্র 25 শতাংশ কাজ হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে ৷ পরে 2021 সালে রাজ্য সরকার এই উড়ালপুলের বাকি অংশটি ভাঙতে রাজি হয় ৷ সেই অনুযায়ী জুন মাসে কাজ শুরু হয় এবং 2022 সালের অগস্ট নাগাদ তা শেষ হয় ৷ আজ তা অতীত... কিন্তু স্মৃতি ফিরে আসে ৷