কলকাতা, 8 জুলাই : 23 বছর ধরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন । তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, বাগ্মীতা, প্রজ্ঞা নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কাছে এক দৃষ্টান্ত । বাংলার রাজনীতিতে আজও সমানভাবে উজ্জ্বল তিনি । কিন্তু এক সময়ের সেই দাপুটে জননেতার জীবনেও নানা ঘটনা রয়েছে, যা ভাবাতে বাধ্য করে । কখনও গোপনে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ , কখনও ময়দানে সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্য শুনতে যাওয়া । ঢাকার ছোট্ট গনা থেকে দেশপ্রেমী যুবক জ্যোতি বসুর জীবনের নানা অজানা গল্প আজও স্মরণীয় ।
বারুদির শৈশব
জ্যোতি বসুর পৈতৃক ভিটে ছিল ঢাকার বারুদি গ্রামে । একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা । ডাকনাম ছিল গনা । শৈশবের বেশ কয়েকদিন এখানেই কেটেছিল তাঁরা । জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর বারুদির বাড়িটায় গ্রন্থাগার তৈরি হয় । তাঁর শেষ ইচ্ছাও ছিল এটি ।
স্কুলে ভরতির সময় নাম বদল
1914 সালের 8 জুলাই জন্মেছিলেন জ্যোতি বসু । কলকাতার এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা । তাঁর আসল নাম ছিল জ্যোতিরিন্দ্র বসু । কিন্তু স্কুলে ভরতি হতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন তাঁর বাবা নিশিকান্ত বসু । যখন ছেলেকে লরেটো স্কুলে ভরতি করতে নিয়ে যান, তখন স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয় নামটা বড় হয়ে যাচ্ছে । শেষমেশ তাঁর বাবা জ্যোতিরিন্দ্র থেকে নামটা ছোটো করে জ্যোতি বসু করে দেন । তখন বছর দশেক ভাড়াবাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে ছিলেন জ্যোতি বসু । পরে হিন্দুস্থান পার্কে নিজেদের ঘর নিয়ে থাকা শুরু করেন । সেখানেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, তাদের জীবন দর্শন, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন । প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজি অনার্স করেন ।
21 বছরে প্রথম চা
21 বছরে না কি প্রথমবার চায়ের কাপ মুখে তুলেছিলন জ্যোতি বসু । কারণ চা খাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বাবার কড়া বারণ ছিল ।
খাদির কাপড় পরে সুভাষতচন্দ্রের ভাষণ শুনতে যান জ্যোতি বসু
দেশে বিশেষ করে কলকাতায় তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন বড় আকার ধারণ করেছে । চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ঘটনায় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ও ইরেজরা মুখোমুখি । নিরস্ত্র অবস্থায় আত্মাহুতি দিয়েছেন বিপ্লবীরা । এই ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন আর স্কুল যাননি জ্যোতি বসু । খাদির কাপড় পরে ময়দানে সুভাষচন্দ্র বসুর ভাষণ শুনতে যান তিনি । এমনকি ফেরার পথে ইংরেজ সিপাহিদের মুখোমুখি হয়েছিলেন । তবে বাচ্চা ছেলেটি সেদিন ছুটে পালিয়ে আসেনি । উলটে ইংরেজদের চোখে চোখ রেখেই নিজের ছন্দে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি ।
ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েই রাজনীতিতে পদার্পণ
1935 সাল । 21 বছর বয়সে আইন পড়তে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন জ্যোতি বসু । সেখানে হিটলার বিরোধী আন্দোলেন, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় চলা নানা আন্দোলন তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে । পরে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন তিনি । এরপর থেকে রাজনীতিতে পথচলা শুরু । ব্রিটেনে থাকাকালীন প্রথমে ইন্ডিয়ান লিগ, পরে লন্ডন মজলিস সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি ।
জেলে যান জ্যোতি বসু
1948 সাল । 28 ফেব্রুয়ারি থেকে 6 মার্চ পর্যন্ত মহম্মদ আলি পার্কে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় । সেখানে শাসক দলের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন কমিউনিস্ট সদস্যরা । এর জেরে 26 মার্চ জ্যোতি বসুকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয় ।
ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ
জ্যোতি বসু ও সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মধ্যে বেশ সখ্যতা ছিল । বাংলাদেশ যুদ্ধের আগের সময় । একবার গোপনে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে জ্যোতি বসুর সাক্ষাৎ করিয়েছিলেন সিদ্ধার্থশংকর রায় । সেদিন রাত এগোরোটায় সিদ্ধার্থশংকর তাঁর স্ত্রী মায়া রায়ের গাড়ি নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করেন । জ্যোতি বসুকে নিয়ে পৌঁছে যান 1 সফদরগঞ্জ রোড । ইন্দিরা গান্ধির বাসভবনে । সেখান থেকে ঘণ্টাখানেক পর বেরিয়ে, দুজনেই রাস্তা ভুল যান । এমনকি ঘণ্টা খানেক বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাননি । শেষমেশ স্থানীয় থানার দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবেন সিদ্ধার্থশংকর । কিন্তু তাতে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা জানাজানি হয়ে যেতে পারে । কিছুক্ষণ পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ি ফেরে দু'জনে ।
দেশের প্রথম মোবাইল পরিষেবার উদ্বোধন
1995 সাল। জ্যোতি বসু দেশের প্রথম মোবাইল পরিষেবার উদ্বোধন করেছিলেন । মোবাইলে প্রথমবার তৎকালীন কেন্দ্রীয় সম্প্রচারমন্ত্রী সুখরামের সঙ্গে কথা বলেন তিনি
কিউবা সফর
1993 সাল । কিউবা থেকে আমন্ত্রণ এল জ্যোতি বসুর । কিউবা সফরে একদিন রাতে ঘুমোতে যাবেন । তখন খবর পান ফিডেল কাস্ট্রো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন । তারপর সীতারাম ইয়েচুরিকে সঙ্গে নিয়ে ফিডেল কাস্ট্রোর সঙ্গে দেখা করতে যান জ্যোতি বসু । মাঝরাতেই প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলে সেই সাক্ষাৎ পর্ব ।
নেপাল সফরে মন্দির ভ্রমণ
1989 সাল । সীতারাম ইয়েচুরিকে নিয়ে নেপাল সফরে যান জ্যোতি বসু । সেখানে নেপাল সরকার জ্যোতি বসুর জন্য পশুপতিনাথ মন্দির দর্শনের ব্যবস্থা করেন । সেদিন ইয়েচুরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, মন্দির দর্শনে কেন না বললেন না জ্যোতি বসু । একটি দারুণ উত্তর দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু । বলেছিলেন, "বিদেশের অতিথিদের আমরা প্রায় রাজঘাটে নিয়ে যাই । তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু গান্ধিবাদী নয় । ঠিক সেভাবেই আমি নাস্তিক হলেও অতিথিদের আমন্ত্রণে পশুপতিনাথ মন্দির দর্শনে যাব ।"
প্রধানমন্ত্রী পদে নাম প্রস্তাব
1996 সাল । অকংগ্রেসী দলগুলি নিয়ে যুক্ত ফ্রন্ট তৈরি হল দিল্লিতে । তাদের নেতা হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হল জ্যোতি বসুর । কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় কমিটি সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেয় ।
উপ-মুখ্যমন্ত্রী
উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অর্থ ও পরিবহন দপ্তর সামলছিলেন জ্যোতি বসু ।
23 বছর বাংলাকে শাসন করেছে যে মস্তিষ্ক তা এখনও সংরক্ষিত রাখা হয়েছে । বেঙ্গালুরুর NIMHANS-এ সংরক্ষিত আছে জ্যোতি বসুর মস্তিষ্ক।