কলকাতা, 7 অক্টোবর: বছরের 365 দিন তাঁর কাটে শহরের যান নিয়ন্ত্রণে । কিন্তু পুজোর প্রাক্কালে সেই হাতেই ওঠে তুলি । গড়ে তোলেন একের পর এক দেবী প্রতিমা । বাঁশদ্রোণীর বাসিন্দা সুকুমার মণ্ডল । পেশায় তিনি ট্র্যাফিক কনস্টেবল । তবে এই পেশার পাশে তাঁর রয়েছে আরও এক নেশা, তা হল দেবীমূর্তি বানানো । ছোট থেকে দীর্ঘ লড়াই পেরিয়েও নিজের শখকে ধরে রেখেছেন ৷ তাই বাড়ির বিপরীতেই তৈরি করেছেন বিরাট এক স্টুডিয়ো । সেখানেই তিনি তৈরি করছেন দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী ।
ছোট থেকেই মাটির প্রতি এক অজানা ভালোবাসা সুকুমার মণ্ডলের । মাটি নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন তিনি । স্কুল থেকে ফেরার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দেখতেন শিল্পীদের প্রতিমা বানানো । বাড়ি ফিরে সেগুলোকে ভেবেই তিনি তৈরি করতেন ছোট ছোট মাটির পুতুল । তারপর ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রথম দেবী মূর্তি তৈরি করেন তিনি । অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিক্রি হল প্রথম তাঁর হাতে তৈরি প্রতিমা, কালী মূর্তি। প্রথম দুর্গামূর্তি গড়া নবম শ্রেণিতে, তবে তা বিক্রি হয়নি ।
দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর কাছে আসেন পাড়ার পুজো কর্তারা । তাঁর পাড়া পঞ্চদুর্গার ঠাকুর বানানোর গুরুদায়িত্ব আসে সুকুমার মণ্ডলের কাঁধে ।
সুকুমারের কথায়, "ওই প্রথম অত বড় অর্ডার পাওয়ায় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । আমার গুরু নটু সমাদ্দারের সঙ্গে তখন যোগাযোগ করি । আগে তাঁর স্টুডিয়োতে গিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছি । তাঁকে পুরো বিষয়টা খুলে বলি, আমার সমস্যা ছিল দেবীর চক্ষুদান নিয়ে । সেই প্রথমবার দেবীর চোখ দান করেছিলেন আমার গুরু । তবে এখন সব ঠাকুরের চোখদান আমিই করি ।"
তবে নেশার পথে হেঁটে গেলেও পকেট ভরে না । একদিকে দেবীমূর্তি বানানোর নেশা, অন্যদিকে পড়াশোনা । পরিবারে সেই সময় নেমে আসে আর্থিক দুর্যোগ । তাই প্রতিমা বানানোকে পাশে রেখেই সুকুমার মণ্ডল শুরু করেন টিউশন । তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিতে থাকেন বিভিন্ন সরকারি চাকরির । অবশেষে 2012 সালে পরিবারে নেমে আসে স্বস্তির হাসি । কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক গার্ডের কনস্টেবল পদে যুক্ত হন সুকুমার মণ্ডল ।
আরও পড়ুন: চলমান ট্রাম যেন দুর্গাপুজোর ক্যানভাস, নস্ট্যালজিয়ার হাতছানি
তিনি জানান, "2009 সালে প্রথম চাকরি পাই, তবে বেশ কিছু সমস্যা থাকার কারণে চাকরিতে যোগ দিই 2012 সালের ডিসেম্বর মাসে । সেই বছর আমার হাতে ছিল প্রায় 12টি ঠাকুর তৈরির অর্ডার ।" এখন নেশা ও পেশা নিয়ে জমজমাট সুকুমার মণ্ডলের জীবন ।
জরুরি ভিত্তিক পরিষেবার অন্যতম সৈনিক পুলিশ । যখন সারা বিশ্বের মানুষ আনন্দে মজে থাকেন তখন সমাজকে বিপদমুক্ত রাখার কঠোর ভূমিকা নেয় তারাই । তাই পুজোর সময় বেশ চাপ থাকে সুকুমার মণ্ডলের ।
তিনি বলেন, "পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকে আমি দুপুরের ডিউটি নিয়ে থাকি । দুপুর দুটো থেকে প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত ডিউটি করি । তারপর বাড়ি ফিরেই কোনওমতে কিছু খেয়ে লেগে পড়ি ঠাকুর বানানোর কাজে । কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সকাল হয়ে যায় । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, আবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত স্টুডিয়োতে ঠাকুর তৈরি করি ।"
তবে শেষ মুহূর্তের কাজের জন্য ডিউটি থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়েছেন তিনি । কিন্তু এখন ছুটি নিলেও পুজোতে সম্পূর্ণ ডিউটিতেই মগ্ন থাকবেন সুকুমার । তাঁর কথায়, "এই কাজে আমি যেতে পারতাম না যদি না বড়বাবু আমাকে সাহায্য করতেন । আমার থানার সকলে আমায় খুব উৎসাহ দেন আমার এই শিল্পসত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ।"
এমনকি গত বছর পুলিশ কোয়ার্টারেও পূজিত হয়েছিলেন ট্রাফিক এই কনস্টেবলের হাতে তৈরি প্রতিমা । এরই সঙ্গে সুকুমার মণ্ডল জানিয়েছেন, এই বছর তাঁর হাতে রয়েছে 9টি প্রতিমা তৈরির অর্ডার । তবে যে পরিবার একসময় তাঁকে ঠাকুর বানানোর জন্য শাসন করত, আজ সেই মণ্ডল পরিবারই তাঁর অন্যতম সঙ্গী । তাঁর স্ত্রী ও ছেলের উপরেই তিনি দিয়ে রাখেন বেশকিছু গুরুদায়িত্ব ।