কলকাতা, 8 মার্চ : বেশ কিছুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতিতে যেন 'পেরেস্ট্রয়িকা'। আঠেরোর উদ্দামে খোলা হাওয়ায় কী পিছিয়ে পড়ছে ছেলেরা? ঐশী ঘোষ, তীর্ণা ভট্টাচার্য, মিমোসা ঘোড়াই, এঁদের দাপটে যেন কোথাও পিছিয়ে পড়ছে আঠেরোর তরুণরা । প্রশ্ন উঠেছে তবে কী মেয়েদের আঁচলের ছায়ায় ঢাকা পড়ছে ছেলেদের দল? তা মানতে একেবারেই নারাজ মেয়েরা । তাঁদের বক্তব্য পরিষ্কার, সমতা । ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই তাঁরা ছাত্র রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, তুলে ধরতে চান ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি ও অধিকার । অর্থাৎ, সমানাধিকারে তাঁরা ছেলেদের জন্যও রাখছেন বিশেষ জায়গা ।
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বেশ কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে ছাত্রীদের । দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের সভানেত্রী পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ রাজ্যেরই মেয়ে ঐশী ঘোষ । আবার রাজ্যের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে কার্যনির্বাহী পদগুলির অধিকাংশেই জিতেছিলেন ছাত্রীরা । সেন্ট্রাল প্যানেলের পাঁচ পদের মধ্যে তিনটি পদে জিতেছিলেন তিন ছাত্রী । সভানেত্রী পদে জয়ী হয়েছিলেন মেদিনীপুরের মেয়ে মিমোসা ঘোড়াই । তারপরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভোট । সেই ভোটেও আর্টস ফ্যাকাল্টি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের চেয়ারপারসন পদে জয়ী হন তীর্ণা ভট্টাচার্য । এভাবেই বিগত কয়েক বছর ধরে ছাত্র রাজনীতিতে ছেলেদের পিছনে ফেলে প্রথম সারিতে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে মেয়েদের ।
এভাবে প্রথম সারিতে এগোনোকে কীভাবে দেখছেন মেয়েরা? এটা কী নারীর ক্ষমতায়নে আরেক ধাপ এগোনো না অন্য কিছু?
রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের মহিলাদের আসা জরুরি বলে মনে করেন এসএফআই নেত্রী ঐশী ঘোষ । কেবলমাত্র রাজনীতি নয়, সমাজের অগ্রসরে মহিলাদের রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি । তাঁর কথায়, মহাভারতের সমাজেও মহিলাদের গুরুত্ব ছিল । সেই প্রাচীন রাজনীতিতেও ছিলেন মহিলারা । রাজ্য রাজনীতিতে মহিলারা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন বলে মনে করেন ঐশী । একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, বামপন্থী রাজনীতিতে মহিলাদের গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম । ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে যে প্রার্থী তালিকা তৈরি হচ্ছে সেখানেও নতুন প্রজন্মের নবীন মহিলাদের স্থান রয়েছে । তাঁর দাবি, বিজেপি এবং তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে বাম নেত্রীরাই প্রকৃত জবাব দিতে পারবে ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের চেয়ারপারসন ও দর্শন শাস্ত্রের ছাত্রী তীর্ণা ভট্টাচার্য বলেন, "আমরা যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাসী । তাঁর সঙ্গে আমরা যে সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করছি সেই সংগঠন তাঁদের মহিলা কমরেডদের উপর ভরসা রাখে । সেই ভরসা থেকেই আমাদের এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে । সমাজে যে একটা ধারণা আছে যে, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, এই কাজগুলো মেয়েদের জন্য নয় । এইরকম পুরানো ধারণাগুলোকেই আমরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিই মাত্র । ছাত্র বা ছাত্রী বলব না, আমি বারবার যৌথ নেতৃত্বের কথা বলব । তবে দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা যেমন ছেলেদের আছে, মেয়েদেরও একইভাবে আছে । মেয়েরাও পারে, এটা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন নেই । কিন্তু, একটা ধারণা রয়েছে এখনও যে, মেয়েরা পারে না । সেই ধারণা ভাঙতেই শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মেয়েরা আরও বেশি এগিয়ে আসছে । এখানে ছেলেদের পিছনে ফেলার বা তাঁদের প্রতিপক্ষ করার কোনও বিষয়ই নেই । এখানে যার যা পছন্দ সে সেটা করবে । অপ্রেশন কমানোটা বিষয় । প্রতিযোগিতার জায়গা নেই ।"
আরও পড়ুন : ময়দানের সম্রাজ্ঞীরা
প্রায় একই বক্তব্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভানেত্রী মিমোসা ঘোড়াইয়েরও । তিনি বলেন,"আমাদের দিদা-ঠাকুমার সময়ে মেয়েরা শুধু ঘরের করবে, এরকম ধারণা ছিল । বিভিন্ন কাজ ভাগ করে দেওয়া হতো । সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রায় সব কাজেই, সব ক্ষেত্রেই ছেলে মেয়ে সমানভাবে জায়গা করে নিচ্ছে । ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে ছাত্র ছাত্রীদের দাবি তুলে ধরতে হয় । ছাত্র ছাত্রীদের দাবির কথা কী শুধু ছেলেরাই বলবে? নিশ্চয়ই নয় । ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে দাবি উঠে আসে । ছেলে-মেয়ে নয়, এগিয়ে আসা বিষয়টাই গুরুত্বপূর্ণ । সেখান থেকে মেয়েরা বুঝেছে তাঁদেরও লড়াই করতে হবে । সবার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে । এখন হয়তো এই কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে । পরবর্তীকালে আমরা হয়তো আরও অনেককে দেখতে পাব এগিয়ে আসতে । ইতিহাসেও মেয়েরা ছিল । কিন্তু, একসঙ্গে আসেননি বলেই এখন হয়তো আমাদের নেতৃত্বে আসা বিষয়টা নজরে আসছে । ছেলে-মেয়ের সংখ্যাটা সমান হয়ে গেলে তখন হয়তো এটা আর চোখে লাগবে না । তখন মনে হবে সবাই এগিয়ে আসছে । ছাত্রদের পিছনে ফেলে মেয়েরা এগিয়ে আসছে, কারণ মেয়েদের সংখ্যাটা কম ছেলেদের থেকে তুলনামূলকভাবে । সেটা বাড়লে হয়তো আর কেউ আলাদা করে বলবে না । নারী ক্ষমতায়নের একটা ধাপ হতেই পারে এটা । তবে, সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সবাইকে নিয়ে চলা । ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবার দাবি আমার দাবি হতে হবে ।"
আরও পড়ুন : বিয়ে এড়াতে ছাড়েন বাড়ি, অধ্যাবসায়েই ধন্যি মেয়ে সাইনুর
প্রথম সারিতে থেকে মেয়েদের নেতৃত্ব দেওয়াকে কেমনভাবে দেখছেন ছেলেরা? তাঁরা কী মেনে নিতে পারছেন মহিলা নেতৃত্ব? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও এসএফআই ছাত্রনেতা শুভজিৎ সরকার বলেন, "মহিলা, পুরুষ হিসেবে এটা দেখা উচিত নয় । যে দায়িত্ব সামলাতে পারবেন, যাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, সেই নেতৃত্ব দেবেন । তা সে মহিলা হতে পারে কিনবা পুরুষ । কিনবা অন্য কোনও লিঙ্গেরও হতে পারেন । তবে সমাজে, চারপাশের পরিবেশে আমরা এখনও দেখতে পাই মেয়েরা বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত । সেই জায়গা থেকে মেয়েদের বেশি সুযোগ দেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয় । কারণ, তাঁদের তুলে আনতে হবে । যে কোনও দুর্বল শ্রেণিকে উপরে তুলে আনার জন্য আমরা সবসময় বলি । তবে, এটা মাথায় রাখতে গিয়ে আমরা যেন কোনও দিন গুণমানের সঙ্গে আপোস না করি ।" তিনি আরও বলেন, " যদি আমার কাছে একজন ছেলে আছে সে হয়তো বেশি যোগ্য, তাঁকে সুযোগ না দিয়ে একজন মেয়েকে সুযোগ দিলাম সে মেয়ে বলে । সেটা হলে মুশকিল । সেদিকটাও নজরে রাখতে হবে যাতে ছেলে হোক বা মেয়ে কিনবা অন্য লিঙ্গের কেউ, যোগ্যতা থাকলে যেন সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় ।"