ETV Bharat / state

COPD কী, কেন গোটা জীবন সঙ্গে থেকে যায় এই অসুখ? - COPD সম্পর্কিত তথ্য

COPD-তে আক্রান্ত হওয়া মানে, গোটা জীবন এই অসুখটিকে বয়ে নিয়ে চলা । একবার এই অসুখ কারও হল মানে, এই অসুখ তাঁর সঙ্গে সারা জীবন থেকে যাবে । COPD আসলে কী? কেন হয়? কীভাবে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা সম্ভব? এসব নিয়ে বলেছেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী ।

ফোটো সৌজন্যে - Pixabay
author img

By

Published : Nov 21, 2019, 10:22 PM IST

কলকাতা, 21 নভেম্বর : COPD-তে আক্রান্ত হওয়া মানে, গোটা জীবন এই অসুখটিকে বয়ে নিয়ে চলা । একবার এই অসুখ কারও হল মানে, এই অসুখ তাঁর সঙ্গে সারা জীবন থেকে যাবে । এই অসুখে শ্বাসনালী ক্রমে আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়তে থাকে‌ । খুব বাড়াবাড়ি হলে আক্রান্তকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হতে পারে । সেক্ষেত্রে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় । COPD আসলে কী? কেন হয়? কীভাবে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা সম্ভব? এসব নিয়ে বলেছেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী ।

COPD আসলে কী?

COPD অর্থাৎ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ় । ক্রনিক কথাটির অর্থ সঙ্গে থাকে, বহুদিন । অর্থাৎ, এমন নয় যে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো কিছু দিন হল, তারপর রোগ সেরে গেল । যিনি COPD-তে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে এটা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থেকে যায় । অবস্ট্রাক্টিভ অর্থাৎ, একটি অবস্ট্রাকশন । অর্থাৎ ফুসফুসের মধ্যে হাওয়া চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে । এবং, এই বাধাটি সঙ্গে থেকে যাচ্ছে । এজন্য এটা ফুসফুসের একটি ক্রনিক অবস্ট্রাকশন । কেন এমন হচ্ছে? আমাদের শ্বাসনালীর দু'টি অংশ আছে । একটি হল এয়ার ওয়ে, যেটা মুখের মধ্যে থেকে গলা দিয়ে নেমে দু'দিকে ভাগ হয়ে ফুসফুসের ডান এবং বাম দিকে পৌঁছেছে । এরপরে এই দু'টি ভাগ আরও বিভিন্ন ভাগ হয়ে ফুসফুসের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছেছে । ফুসফুস আসলে কয়েক লাখ বেলুন একসঙ্গে থাকার মতো । ফুসফুসের একটি অংশ এয়ার ওয়ে । এই অংশটি সংকীর্ণ হয়ে যায় । এর ফলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দু'টি ক্ষেত্রেই বাধা থাকে । শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে যথেষ্ট অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করছে না । আর, শ্বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে শরীরের মধ্যে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল, সেটা পুরোটা বের হতে পারছে না । COPD আক্রান্তের সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক্ষেত্রে বেশি সমস্যা তৈরি হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোপুরি বের হতে না পারার জন্য । অ্যাজ়মায় আক্রান্তদের শ্বাসনালীও সংকীর্ণ হয়ে যায় । তবে তাঁদের শ্বাসনালী আবার স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি চলে আসতে পারে । COPD আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শ্বাসনালী সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টি ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে । সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক ধাক্কায় শ্বাসনালী অনেকটা সংকুচিত হয়ে যায় । এক্ষেত্রে কিছুটা পুনরুদ্ধার সম্ভব । কিন্তু, আগের স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও ফিরে আসে না ।

কেন হয় COPD?

সাধারণত ধোঁয়া এবং ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড থেকে COPD হয় । যাঁরা ধূমপান করেন, সালফার এবং কার্বনের অক্সাইড, মনোক্সাইড, ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ধোয়া তাঁদের ফুসফুসে ঢুকছে । ধোঁয়ার মধ্যে অনেক পরিমাণে কার্বন রয়েছে । কেউ হয়তো ধূমপান করেন না । কিন্তু, তাঁর আশপাশে কেউ ধূমপান করলে, সেই ধোঁয়া তাঁর শরীরে প্রবেশ করছে । কেউ হয়তো অনেক সময় ধরে উনুন জ্বালিয়ে কাজ করেন, এমন উনুন যাতে অনেক ধোঁয়া হয় । এসব ক্ষেত্রেও COPD হতে পারে । আগে মনে করা হত, COPD শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি হয় । এখন এদেশে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে মহিলারাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন । এই সব আক্রান্তের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে COPD ধরা পড়ে না, কারণ রোগ নির্ণয় করা হয় না । গ্রামের দিকে এমন অনেক বাড়ি রয়েছে যেখানে পুরুষরা মাঠে কাজ করছেন, আর মহিলারা ঘরে কাজ করছেন । ওই সব পুরুষ হয়তো মাঠে ধূমপান করছেন, তবে সেখানে অনেক হাওয়া চলাচল রয়েছে । এই জন্য কিছুটা হলেও সেটা ডাইলুশন হচ্ছে । অথচ, বাড়িতে যে মহিলা উনুনে রান্না করছেন, সেখানে তেমন খোলামেলা পরিবেশ নাও থাকতে পারে । তার ক্ষেত্রে ধোঁয়া অনেক বেশি ক্ষতি করছে । এর সঙ্গে, ওই ব্যক্তি বাড়িতেও ওই মহিলার সামনে যদি ধূমপান করেন, তাহলে ওই ধোঁয়া ওই মহিলার শরীরে প্রবেশ করছে । এমন কারণেও গ্রামের মহিলাদের অনেকের মধ্যে COPD রয়েছে । COPD বেড়ে চলেছে । কেউ হয়তো এমন কোনও কারখানায় কাজ করছেন, যেখানে অনেক ধোঁয়া বা ধুলো রয়েছে । যে ট্রাফিক পুলিশ অনেক ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করছেন । এসব ক্ষেত্রে, ধূমপান না করলেও COPD হতে পারে । এমন অনেক দমকলকর্মী রয়েছেন, যাঁরা হয়তো ধূমপান করেন না । কিন্তু আগুন নেভানোর কাজ করার জন্য, তাঁদের অনেকের COPD হতে পারে । কারণ, আগুনের ধোয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ থাকে । এগুলি ধূমপানের থেকেও বেশি ক্ষতিকর ।

COPD-র চিকিৎসা কী রয়েছে?

চিকিৎসার ক্ষেত্রে, প্রথমেই প্রতিরোধের বিষয়টি বলা যায় । ধোঁয়া যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা দেখতে হবে । অর্থাৎ, কারও ক্ষেত্রে COPD না হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনই, COPD হলে সেটা যেন বাড়তে না দেওয়া হয় । COPD শুরু হওয়া মানে পাহাড়ের উপর থেকে একটি পাথর ঠেলে দেওয়ার মতো । ওই পাথরটিকে আর না ঠেললেও, নিচের দিকে নামতে থাকবে । তেমনই, COPD হওয়া মানে, শ্বাসনালীর সংকুচিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি চলতেই থাকবে । যদি, COPD হওয়ার পরে, ধূমপান অথবা অন্য কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ নাও করে, তাও বাড়তে থাকে । আর যদি ধূমপান বা অন্য কোনও কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করতে থাকে, তা হলে COPD-র সমস্যা আরও বেশি বাড়তে থাকে ।

চিকিৎসার একটি বিষয় হল প্রতিরোধ । অন্য একটি বিষয় হল, ফুসফুসে হাওয়া প্রবেশ এবং ফুসফুস থেকে হাওয়া বের হওয়ার ব্যবস্থাকে ভালো করা অর্থাৎ, শ্বাসনালীকে চওড়া করা । এর জন্য ওষুধ রয়েছে । বেশ কিছু খাওয়ার ওষুধ রয়েছে । তবে এই ওষুধ সরাসরি পেটে যায় । এর পরে রক্তবাহিত হয়ে গোটা শরীরে পৌঁছয় । এক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করা হলে, ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছচ্ছে । সেখানে কাজ করছে, অন্যান্য অর্গানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না । ইনহেলারের ক্ষেত্রে ওষুধের পরিমাণও অনেক কম লাগে । কারণ মুখে খাওয়া ওষুধের অনেকটা পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায় । ভ্যাকসিন রয়েছে । COPD আক্রান্তদের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ বারে বারে হয় । ভাইরাল নিউমোনিয়া হয়, ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয় । এগুলি যাতে না হয় তার জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে । নিয়মিত ভ্যাকসিন নেওয়া হলে COPD-র জেরে যে সংক্রমনের বাড়াবাড়ি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং শীত আসা-যাওয়ার সময় দেখা দেয়, সেগুলি অনেক কম হবে । COPD-র বাড়াবাড়ি কম হলে শ্বাসনালীর সরু হওয়ার ব্যাপারটাও কম হবে ।

যে কোনও বয়সের মানুষই কি COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন?

আগে ভাবা হত, 50-60 বছর বয়সের আগে COPD হয় না । তখন, 50-60 বছর বয়সের আগে শ্বাসকষ্ট হলে বলা হত অ্যাজ়মা । বিশ্বজুড়ে এখন এই ধারণা পুরো বদলে গিয়েছে । এখন এটুকু বলা যায়, কেউ যদি টানা পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন 10-15 টি করে সিগারেট খান তাহলে তারও COPD হতে পারে । কেউ যদি 15-18 বছর বয়সে ধূমপান শুরু করেন, তাঁর COPD হতে 40 বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে না । যে কোনও বয়সে, বেশ কিছুদিন খুব বেশি মাত্রায় ধোঁয়া, কার্বন বা ধুলোর সংস্পর্শে এলে COPD হতে পারে । তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন COPD বাড়ছে । বেশ কিছু কাল ধরে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে আক্রান্ত হওয়ার বয়স কমছে । অর্থাৎ, একসময় ছিল 60-70 বছর বয়স । এখন, 40 বছর বয়সেও COPD দেখা যাচ্ছে । ধূমপানের কারণে 30-32 বছর বয়সিদের মধ্যে এমন কাশি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে শ্বাসনালী এমন শুরু হয়ে গিয়েছে, যেটা COPD-র মতো ।

পরিবেশ দূষণও কি COPD-র কারণ হতে পারে?

অবশ্যই । যে ট্রাফিক পুলিশ ধূমপায়ী নন অথচ, তিনি COPD-তে আক্রান্ত, তিনি কিন্তু পরিবেশ দূষণের শিকার । যে দমকলকর্মীও ধূমপায়ী নন অথচ, COPD-র শিকার, তিনিও কিন্তু দূষিত পরিবেশে কাজ করেছেন, যখন আগুন নেভাতে গিয়েছেন । যে সব মানুষ এমন কারখানার আশপাশে থাকেন, যে সব কারখানায় এমন কিছু পোড়ানো হয় যার জন্য অনেক ধোঁয়া তৈরি হয়, যে ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়ার কারণে শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে । ধূমপান না করে, ধোঁয়া হয় এমন উনুনের পাশে কাজ না করে, ওই ধরনের কোনও কারখানার পাশে থেকে, সেখানকার কোনও মানুষ COPD-তে আক্রান্ত হতে পারেন । COPD একবার কারও হল মানে, তাঁর সঙ্গে থেকে যাবে । তবে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে । যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তাহলে COPD আরও বাড়বে ছাড়া কমবে না ।

শুরুতেই যাতে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন, তার জন্য সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবেন?

প্রতিবছর শীতকালে বেশি সর্দি-কাশি হওয়া । কাশি বেশি দিন থেকে যাওয়া । হালকা শ্বাসকষ্ট হওয়া । সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অথবা, একটু ধোঁয়া লাগল, তখনই বুকে যেন একটু চাপ লাগছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । সকালের দিকে মনে হচ্ছে জানালার ধারে গিয়ে একটু হাওয়া নিতে পারলে ভালো হয়, না হলে দমবন্ধ লাগছে । শুরুতে এই উপসর্গগুলির মাধ্যমে বোঝা যায় যে COPD হচ্ছে । এর সঙ্গে এই হিস্ট্রিও গুরুত্বপূর্ণ যে, আগে ধূমপান করেছেন কি না, ধোঁয়ার পরিবেশে কাজ করেছেন কি না । কেউ COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন কি না, তা নির্ভর করছে পরিবেশ এবং তাঁর অভ্যাসের উপর ।

COPD আক্রান্তরা কোন ধরনের সমস্যায় পড়েন?

COPD আক্রান্তদের নিয়মিত সমস্যা হল শ্বাসকষ্ট, বার বার ফুসফুসে সংক্রমণ হওয়া, কফ জমে যাওয়া, মনে হয় কফ বের হচ্ছে না । বারবার শ্বাসকষ্ট হতে থাকলে শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় । তখন বাইপ্যাপ বা নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটরে দিতে হয় । এর থেকে আরও বেশি বাড়াবাড়ি হলে, COPD আক্রান্তকে তখন ভেন্টিলেটরে রাখতে হতে পারে । ভেন্টিলেটরে রাখার মতো অবস্থায় কোনও COPD আক্রান্ত একবার পৌঁছে গেলে, সব সময় যে তাঁকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে, তার গ্যারান্টি নেই । তখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় ।

কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?

COPD হওয়ার কারণগুলি এড়িয়ে চলার মাধ্যমে এই অসুখের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সম্ভব । উপসর্গগুলি সামান্য দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন যাতে COPD বেশি বেড়ে না যায় ।

কলকাতা, 21 নভেম্বর : COPD-তে আক্রান্ত হওয়া মানে, গোটা জীবন এই অসুখটিকে বয়ে নিয়ে চলা । একবার এই অসুখ কারও হল মানে, এই অসুখ তাঁর সঙ্গে সারা জীবন থেকে যাবে । এই অসুখে শ্বাসনালী ক্রমে আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়তে থাকে‌ । খুব বাড়াবাড়ি হলে আক্রান্তকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হতে পারে । সেক্ষেত্রে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় । COPD আসলে কী? কেন হয়? কীভাবে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা সম্ভব? এসব নিয়ে বলেছেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী ।

COPD আসলে কী?

COPD অর্থাৎ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ় । ক্রনিক কথাটির অর্থ সঙ্গে থাকে, বহুদিন । অর্থাৎ, এমন নয় যে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো কিছু দিন হল, তারপর রোগ সেরে গেল । যিনি COPD-তে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে এটা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থেকে যায় । অবস্ট্রাক্টিভ অর্থাৎ, একটি অবস্ট্রাকশন । অর্থাৎ ফুসফুসের মধ্যে হাওয়া চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে । এবং, এই বাধাটি সঙ্গে থেকে যাচ্ছে । এজন্য এটা ফুসফুসের একটি ক্রনিক অবস্ট্রাকশন । কেন এমন হচ্ছে? আমাদের শ্বাসনালীর দু'টি অংশ আছে । একটি হল এয়ার ওয়ে, যেটা মুখের মধ্যে থেকে গলা দিয়ে নেমে দু'দিকে ভাগ হয়ে ফুসফুসের ডান এবং বাম দিকে পৌঁছেছে । এরপরে এই দু'টি ভাগ আরও বিভিন্ন ভাগ হয়ে ফুসফুসের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছেছে । ফুসফুস আসলে কয়েক লাখ বেলুন একসঙ্গে থাকার মতো । ফুসফুসের একটি অংশ এয়ার ওয়ে । এই অংশটি সংকীর্ণ হয়ে যায় । এর ফলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দু'টি ক্ষেত্রেই বাধা থাকে । শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে যথেষ্ট অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করছে না । আর, শ্বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে শরীরের মধ্যে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল, সেটা পুরোটা বের হতে পারছে না । COPD আক্রান্তের সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক্ষেত্রে বেশি সমস্যা তৈরি হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোপুরি বের হতে না পারার জন্য । অ্যাজ়মায় আক্রান্তদের শ্বাসনালীও সংকীর্ণ হয়ে যায় । তবে তাঁদের শ্বাসনালী আবার স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি চলে আসতে পারে । COPD আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শ্বাসনালী সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টি ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে । সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক ধাক্কায় শ্বাসনালী অনেকটা সংকুচিত হয়ে যায় । এক্ষেত্রে কিছুটা পুনরুদ্ধার সম্ভব । কিন্তু, আগের স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও ফিরে আসে না ।

কেন হয় COPD?

সাধারণত ধোঁয়া এবং ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড থেকে COPD হয় । যাঁরা ধূমপান করেন, সালফার এবং কার্বনের অক্সাইড, মনোক্সাইড, ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ধোয়া তাঁদের ফুসফুসে ঢুকছে । ধোঁয়ার মধ্যে অনেক পরিমাণে কার্বন রয়েছে । কেউ হয়তো ধূমপান করেন না । কিন্তু, তাঁর আশপাশে কেউ ধূমপান করলে, সেই ধোঁয়া তাঁর শরীরে প্রবেশ করছে । কেউ হয়তো অনেক সময় ধরে উনুন জ্বালিয়ে কাজ করেন, এমন উনুন যাতে অনেক ধোঁয়া হয় । এসব ক্ষেত্রেও COPD হতে পারে । আগে মনে করা হত, COPD শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি হয় । এখন এদেশে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে মহিলারাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন । এই সব আক্রান্তের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে COPD ধরা পড়ে না, কারণ রোগ নির্ণয় করা হয় না । গ্রামের দিকে এমন অনেক বাড়ি রয়েছে যেখানে পুরুষরা মাঠে কাজ করছেন, আর মহিলারা ঘরে কাজ করছেন । ওই সব পুরুষ হয়তো মাঠে ধূমপান করছেন, তবে সেখানে অনেক হাওয়া চলাচল রয়েছে । এই জন্য কিছুটা হলেও সেটা ডাইলুশন হচ্ছে । অথচ, বাড়িতে যে মহিলা উনুনে রান্না করছেন, সেখানে তেমন খোলামেলা পরিবেশ নাও থাকতে পারে । তার ক্ষেত্রে ধোঁয়া অনেক বেশি ক্ষতি করছে । এর সঙ্গে, ওই ব্যক্তি বাড়িতেও ওই মহিলার সামনে যদি ধূমপান করেন, তাহলে ওই ধোঁয়া ওই মহিলার শরীরে প্রবেশ করছে । এমন কারণেও গ্রামের মহিলাদের অনেকের মধ্যে COPD রয়েছে । COPD বেড়ে চলেছে । কেউ হয়তো এমন কোনও কারখানায় কাজ করছেন, যেখানে অনেক ধোঁয়া বা ধুলো রয়েছে । যে ট্রাফিক পুলিশ অনেক ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করছেন । এসব ক্ষেত্রে, ধূমপান না করলেও COPD হতে পারে । এমন অনেক দমকলকর্মী রয়েছেন, যাঁরা হয়তো ধূমপান করেন না । কিন্তু আগুন নেভানোর কাজ করার জন্য, তাঁদের অনেকের COPD হতে পারে । কারণ, আগুনের ধোয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ থাকে । এগুলি ধূমপানের থেকেও বেশি ক্ষতিকর ।

COPD-র চিকিৎসা কী রয়েছে?

চিকিৎসার ক্ষেত্রে, প্রথমেই প্রতিরোধের বিষয়টি বলা যায় । ধোঁয়া যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা দেখতে হবে । অর্থাৎ, কারও ক্ষেত্রে COPD না হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনই, COPD হলে সেটা যেন বাড়তে না দেওয়া হয় । COPD শুরু হওয়া মানে পাহাড়ের উপর থেকে একটি পাথর ঠেলে দেওয়ার মতো । ওই পাথরটিকে আর না ঠেললেও, নিচের দিকে নামতে থাকবে । তেমনই, COPD হওয়া মানে, শ্বাসনালীর সংকুচিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি চলতেই থাকবে । যদি, COPD হওয়ার পরে, ধূমপান অথবা অন্য কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ নাও করে, তাও বাড়তে থাকে । আর যদি ধূমপান বা অন্য কোনও কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করতে থাকে, তা হলে COPD-র সমস্যা আরও বেশি বাড়তে থাকে ।

চিকিৎসার একটি বিষয় হল প্রতিরোধ । অন্য একটি বিষয় হল, ফুসফুসে হাওয়া প্রবেশ এবং ফুসফুস থেকে হাওয়া বের হওয়ার ব্যবস্থাকে ভালো করা অর্থাৎ, শ্বাসনালীকে চওড়া করা । এর জন্য ওষুধ রয়েছে । বেশ কিছু খাওয়ার ওষুধ রয়েছে । তবে এই ওষুধ সরাসরি পেটে যায় । এর পরে রক্তবাহিত হয়ে গোটা শরীরে পৌঁছয় । এক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করা হলে, ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছচ্ছে । সেখানে কাজ করছে, অন্যান্য অর্গানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না । ইনহেলারের ক্ষেত্রে ওষুধের পরিমাণও অনেক কম লাগে । কারণ মুখে খাওয়া ওষুধের অনেকটা পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায় । ভ্যাকসিন রয়েছে । COPD আক্রান্তদের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ বারে বারে হয় । ভাইরাল নিউমোনিয়া হয়, ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয় । এগুলি যাতে না হয় তার জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে । নিয়মিত ভ্যাকসিন নেওয়া হলে COPD-র জেরে যে সংক্রমনের বাড়াবাড়ি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং শীত আসা-যাওয়ার সময় দেখা দেয়, সেগুলি অনেক কম হবে । COPD-র বাড়াবাড়ি কম হলে শ্বাসনালীর সরু হওয়ার ব্যাপারটাও কম হবে ।

যে কোনও বয়সের মানুষই কি COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন?

আগে ভাবা হত, 50-60 বছর বয়সের আগে COPD হয় না । তখন, 50-60 বছর বয়সের আগে শ্বাসকষ্ট হলে বলা হত অ্যাজ়মা । বিশ্বজুড়ে এখন এই ধারণা পুরো বদলে গিয়েছে । এখন এটুকু বলা যায়, কেউ যদি টানা পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন 10-15 টি করে সিগারেট খান তাহলে তারও COPD হতে পারে । কেউ যদি 15-18 বছর বয়সে ধূমপান শুরু করেন, তাঁর COPD হতে 40 বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে না । যে কোনও বয়সে, বেশ কিছুদিন খুব বেশি মাত্রায় ধোঁয়া, কার্বন বা ধুলোর সংস্পর্শে এলে COPD হতে পারে । তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন COPD বাড়ছে । বেশ কিছু কাল ধরে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে আক্রান্ত হওয়ার বয়স কমছে । অর্থাৎ, একসময় ছিল 60-70 বছর বয়স । এখন, 40 বছর বয়সেও COPD দেখা যাচ্ছে । ধূমপানের কারণে 30-32 বছর বয়সিদের মধ্যে এমন কাশি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে শ্বাসনালী এমন শুরু হয়ে গিয়েছে, যেটা COPD-র মতো ।

পরিবেশ দূষণও কি COPD-র কারণ হতে পারে?

অবশ্যই । যে ট্রাফিক পুলিশ ধূমপায়ী নন অথচ, তিনি COPD-তে আক্রান্ত, তিনি কিন্তু পরিবেশ দূষণের শিকার । যে দমকলকর্মীও ধূমপায়ী নন অথচ, COPD-র শিকার, তিনিও কিন্তু দূষিত পরিবেশে কাজ করেছেন, যখন আগুন নেভাতে গিয়েছেন । যে সব মানুষ এমন কারখানার আশপাশে থাকেন, যে সব কারখানায় এমন কিছু পোড়ানো হয় যার জন্য অনেক ধোঁয়া তৈরি হয়, যে ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়ার কারণে শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে । ধূমপান না করে, ধোঁয়া হয় এমন উনুনের পাশে কাজ না করে, ওই ধরনের কোনও কারখানার পাশে থেকে, সেখানকার কোনও মানুষ COPD-তে আক্রান্ত হতে পারেন । COPD একবার কারও হল মানে, তাঁর সঙ্গে থেকে যাবে । তবে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে । যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তাহলে COPD আরও বাড়বে ছাড়া কমবে না ।

শুরুতেই যাতে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন, তার জন্য সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবেন?

প্রতিবছর শীতকালে বেশি সর্দি-কাশি হওয়া । কাশি বেশি দিন থেকে যাওয়া । হালকা শ্বাসকষ্ট হওয়া । সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অথবা, একটু ধোঁয়া লাগল, তখনই বুকে যেন একটু চাপ লাগছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । সকালের দিকে মনে হচ্ছে জানালার ধারে গিয়ে একটু হাওয়া নিতে পারলে ভালো হয়, না হলে দমবন্ধ লাগছে । শুরুতে এই উপসর্গগুলির মাধ্যমে বোঝা যায় যে COPD হচ্ছে । এর সঙ্গে এই হিস্ট্রিও গুরুত্বপূর্ণ যে, আগে ধূমপান করেছেন কি না, ধোঁয়ার পরিবেশে কাজ করেছেন কি না । কেউ COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন কি না, তা নির্ভর করছে পরিবেশ এবং তাঁর অভ্যাসের উপর ।

COPD আক্রান্তরা কোন ধরনের সমস্যায় পড়েন?

COPD আক্রান্তদের নিয়মিত সমস্যা হল শ্বাসকষ্ট, বার বার ফুসফুসে সংক্রমণ হওয়া, কফ জমে যাওয়া, মনে হয় কফ বের হচ্ছে না । বারবার শ্বাসকষ্ট হতে থাকলে শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় । তখন বাইপ্যাপ বা নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটরে দিতে হয় । এর থেকে আরও বেশি বাড়াবাড়ি হলে, COPD আক্রান্তকে তখন ভেন্টিলেটরে রাখতে হতে পারে । ভেন্টিলেটরে রাখার মতো অবস্থায় কোনও COPD আক্রান্ত একবার পৌঁছে গেলে, সব সময় যে তাঁকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে, তার গ্যারান্টি নেই । তখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় ।

কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?

COPD হওয়ার কারণগুলি এড়িয়ে চলার মাধ্যমে এই অসুখের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সম্ভব । উপসর্গগুলি সামান্য দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন যাতে COPD বেশি বেড়ে না যায় ।

Intro:কলকাতা, ২১ নভেম্বর: COPD-তে আক্রান্ত হওয়া মানে, গোটা জীবন এই অসুখটিকে বয়ে নিয়ে চলা। একবার এই অসুখ কারও হল মানে, এই অসুখ তাঁর সঙ্গে সারা জীবন থেকে যাবে। এই অসুখে শ্বাসনালী ক্রমে আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়তে থাকে‌। খুব বাড়াবাড়ি হলে আক্রান্তকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। COPD আসলে কী? কেন হয়, কীভাবে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা সম্ভব? এ সব নিয়ে বলেছেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী।


Body:COPD আসলে কী?
COPD অর্থাৎ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। ক্রনিক কথাটির অর্থ সঙ্গে থাকে, বহুদিন। অর্থাৎ, এমন নয় যে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো কিছু দিন হল, তার পর রোগ সেরে গেল। যিনি COPD-তে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে এটা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থেকে যায়। অবস্ট্রাক্টিভ অর্থাৎ, একটি অবস্ট্রাকশন। অর্থাৎ ফুসফুসের মধ্যে হাওয়া চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এবং, এই বাধাটি সঙ্গে থেকে যাচ্ছে। এ জন্য এটা ফুসফুসের একটি ক্রনিক অবস্ট্রাকশন। কেন এমন হচ্ছে? আমাদের শ্বাসনালীর দুটি অংশ আছে। একটি হলো এয়ার ওয়ে, যেটা মুখের মধ্যে থেকে গলা দিয়ে নেমে দুই দিকে ভাগ হয়ে ফুসফুসের ডান এবং বাম দিকে পৌঁছেছে। এর পরে এই দুটি ভাগ আরও বিভিন্ন ভাগ হয়ে ফুসফুসের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছেছে। ফুসফুস আসলে কয়েক লক্ষ বেলুন একসঙ্গে থাকার মতো। ফুসফুসের একটি অংশ এয়ার ওয়ে। এই অংশটি সংকীর্ণ হয়ে যায়। এর ফলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দুটি ক্ষেত্রেই বাধা থাকে। শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে যথেষ্ট অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করছে না। আর, শ্বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে শরীরের মধ্যে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল, সেটা পুরোটা বের হতে পারছে না। COPD আক্রান্তের সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক্ষেত্রে বেশি সমস্যা তৈরি হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোপুরি বের হতে না পারার জন্য। অ্যাজমায় আক্রান্তদের শ্বাসনালীও সংকীর্ণ হয়ে যায়। তবে তাঁদের শ্বাসনালী আবার স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি চলে আসতে পারে। COPD আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শ্বাসনালী সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টি ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে। সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক ধাক্কায় শ্বাসনালী অনেকটা সংকুচিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কিছুটা পুনরুদ্ধার সম্ভব। কিন্তু, আগের স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও ফিরে আসে না।

কেন হয় COPD?
সাধারণত ধোঁয়া এবং ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড থেকে COPD হয়। যাঁরা ধূমপান করেন, সালফার এবং কার্বনের অক্সাইড, মনোক্সাইড, ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ধোয়া তাঁদের ফুসফুসে ঢুকছে। ধোঁয়ার মধ্যে অনেক পরিমাণে কার্বন রয়েছে। কেউ হয়তো ধূমপান করেন না। কিন্তু, তাঁর আশপাশে কেউ ধূমপান করলে, সেই ধোঁয়া তাঁর শরীরে প্রবেশ করছে। কেউ হয়তো অনেক সময় ধরে উনুন জ্বালিয়ে কাজ করেন, এমন উনুন যাতে অনেক ধোঁয়া হয়। এসব ক্ষেত্রেও COPD হতে পারে। আগে মনে করা হতো COPD শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। এখন এদেশে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে মহিলারাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই সব আক্রান্তের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে COPD ধরা পড়ে না, কারণ রোগ নির্ণয় করা হয় না। গ্রামের দিকে এমন অনেক বাড়ি রয়েছে যেখানে পুরুষরা মাঠে কাজ করছেন, আর মহিলারা ঘরে কাজ করছেন। ওই সব পুরুষ হয়তো মাঠে ধূমপান করছেন, তবে সেখানে অনেক হাওয়া চলাচল রয়েছে। এই জন্য কিছুটা হলেও সেটা ডাইলুশন হচ্ছে। অথচ, বাড়িতে যে মহিলা উনুনে রান্না করছেন, সেখানে তেমন খোলামেলা পরিবেশ নাও থাকতে পারে। তার ক্ষেত্রে ধোঁয়া অনেক বেশি ক্ষতি করছে। এর সঙ্গে, ওই পুরুষ ব‍্যক্তি বাড়িতেও ওই মহিলার সামনে যদি ধূমপান করেন, তাহলে ওই ধোঁয়া ওই মহিলার শরীরে প্রবেশ করছে। এমন কারণেও গ্রামের মহিলাদের অনেকের মধ্যে COPD রয়েছে। COPD বেড়ে চলেছে। কেউ হয়তো এমন কোনও কারখানায় কাজ করছেন, যেখানে অনেক ধোঁয়া বা ধুলো রয়েছে। যে ট্রাফিক পুলিশ অনেক ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করছেন। এসব ক্ষেত্রেও ধূমপান না করলেও COPD হতে পারে। এমন অনেক দমকলকর্মী রয়েছেন, যাঁরা হয়তো ধূমপান করেন না। কিন্তু আগুন নেভানোর কাজ করার জন্য, তাঁদের অনেকের COPD হতে পারে। কারণ, আগুনের ধোয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ থাকে। এগুলি ধূমপানের থেকেও বেশি ক্ষতিকর।

COPD-র চিকিৎসা কী রয়েছে?
চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রতিরোধের বিষয়টি বলা যায়। ধোঁয়া যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা দেখতে হবে। অর্থাৎ, কারও ক্ষেত্রে COPD না হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয়। তেমনই, COPD হলে সেটা যেন বাড়তে না দেওয়া হয়। COPD শুরু হওয়া মানে পাহাড়ের উপর থেকে একটি পাথর ঠেলে দেওয়ার মতো। ওই পাথরটিকে আর না ঠেললেও, নিচের দিকে নামতে থাকবে। তেমনই, COPD হওয়া মানে, শ্বাসনালীর সংকুচিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি চলতেই থাকবে। যদি, COPD হওয়ার পরে, ধূমপান অথবা অন্য কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ নাও করে, তাও বাড়তে থাকে। আর যদি ধূমপান বা অন্য কোনও কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করতে থাকে, তা হলে COPD-র সমস্যা আরও বেশি বাড়তে থাকে।
চিকিৎসার একটি বিষয় হল প্রতিরোধ। অন্য একটি বিষয় হল, ফুসফুসে হাওয়া প্রবেশ এবং ফুসফুস থেকে হাওয়া বের হওয়ার ব্যবস্থাকে ভালো করা অর্থাৎ, শ্বাসনালীকে চওড়া করা। এর জন্য ওষুধ রয়েছে। বেশ কিছু খাওয়ার ওষুধ রয়েছে। তবে এই ওষুধ সরাসরি পেটে যায়। এর পরে রক্তবাহিত হয়ে গোটা শরীরে পৌঁছয়। এক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করা হলে, ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছচ্ছে। সেখানে কাজ করছে অন্যান্য অর্গানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না। ইনহেলারের ক্ষেত্রে ওষুধের পরিমাণও অনেক কম লাগে। কারণ মুখে খাওয়া ওষুধের অনেকটা পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায়। ভ্যাকসিন রয়েছে। COPD আক্রান্তদের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ বারে বারে হয়। ভাইরাল নিউমোনিয়া হয়, ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয়। এগুলি যাতে না হয় তার জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে। নিয়মিত ভ্যাকসিন নেওয়া হলে COPD-র জেরে যে সংক্রমনের বাড়াবাড়ি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং শীত আসা এবং যাওয়ার সময় দেখা দেয়, সেগুলি অনেক কম হবে। COPD-র বাড়াবাড়ি কম হলে শ্বাসনালীর সরু হওয়ার ব্যাপারটাও কম হবে।

যে কোনও বয়সের মানুষই কি COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন?
আগে ভাবা হতো, ৫০-৬০ বছর বয়সের আগে COPD হয় না। তখন, ৫০-৬০ বছর বয়সের আগে শ্বাসকষ্ট হলে বলা হত অ্যাজমা। বিশ্বজুড়ে এখন এই ধারণা পুরো বদলে গিয়েছে। এখন এটুকু বলা যায়, কেউ যদি টানা পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন ১০-১৫টি করে সিগারেট খান তাহলে তারও COPD হতে পারে। কেউ যদি ১৮ বা ১৫ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করেন, তাঁর COPD হতে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। যে কোনও বয়সে, বেশ কিছুদিন খুব বেশি মাত্রায় ধোঁয়া, কার্বন বা ধুলোর সংস্পর্শে এলে COPD হতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন COPD বাড়ছে। বেশ কিছু কাল ধরে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে আক্রান্ত হওয়ার বয়স কমছে। অর্থাৎ, একসময় ছিল ৬০-৭০ বছর বয়স। আর, এখন, ৪০ বছর বয়সেও COPD দেখা যাচ্ছে। ধূমপানের কারণে ৩০-৩২ বছর বয়সিদের মধ্যে এমন কাশি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে শ্বাসনালী এমন শুরু হয়ে গিয়েছে, যেটা COPD-র মতো।

পরিবেশ দূষণ-ও কি COPD-র কারণ হতে পারে?
অবশ্যই। যে ট্রাফিক পুলিশ ধূমপায়ী নন অথচ, তিনি COPD-তে আক্রান্ত, তিনি কিন্তু পরিবেশ দূষণের শিকার। যে দমকলকর্মীও ধূমপায়ী নন অথচ, COPD-র শিকার, তিনিও কিন্তু দূষিত পরিবেশে কাজ করেছেন, যখন আগুন নেভাতে গিয়েছেন। যে সব মানুষ এমন কারখানার আশপাশে থাকেন, যে সব কারখানায় এমন কিছু পোড়ানো হয় যার জন্য অনেক ধোঁয়া তৈরি হয়, যে ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়ার কারণে শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে তা ওই সব মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। ধূমপান না করে, ধোঁয়া হয় এমন উনুনের পাশে কাজ না করে, ওই ধরনের কোনও কারখানার পাশে থেকে, সেখানকার কোনও মানুষ COPD-তে আক্রান্ত হতে পারেন। COPD একবার কারও হল মানে, তাঁর সঙ্গে থেকে যাবে। তবে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তাহলে COPD আরও পারবে ছাড়া কমবে না।


Conclusion:শুরুতেই যাতে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন, তার জন্য সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবেন?
প্রতিবছর শীতকালে বেশি সর্দি-কাশি হওয়া। কাশি বেশি দিন থেকে যাওয়া। হালকা শ্বাসকষ্ট হওয়া। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অথবা, একটু ধোঁয়া লাগল, তখনই বুকে যেন একটু চাপ লাগছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সকালের দিকে মনে হচ্ছে জানালার ধারে গিয়ে একটু হাওয়া নিতে পারলে ভালো হয়, না হলে দমবন্ধ লাগছে। শুরুতে এই উপসর্গগুলির মাধ্যমে বোঝা যায় যে COPD হচ্ছে। এর সঙ্গে এই হিস্ট্রিও গুরুত্বপূর্ণ যে, আগে ধূমপান করেছেন কি না, ধোঁয়ার পরিবেশে কাজ করেছেন কি না। কেউ COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন কি না, তা নির্ভর করছে পরিবেশ এবং তাঁর অভ্যাসের উপর।

COPD আক্রান্তরা কোন ধরনের সমস্যায় পড়েন?
COPD আক্রান্তদের নিয়মিত সমস্যা হল শ্বাসকষ্ট, বার বার ফুসফুসে সংক্রমণ হওয়া, কফ জমে যাওয়া, মনে হয় কফ বের হচ্ছে না। বারবার শ্বাসকষ্ট হতে থাকলে শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন বাইপ্যাপ বা নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটরে দিতে হয়। এর থেকে আরও বেশি বাড়াবাড়ি হলে, COPD আক্রান্তকে তখন ভেন্টিলেটরে রাখতে হতে পারে। ভেন্টিলেটরে রাখার মতো অবস্থায় কোনও COPD আক্রান্ত একবার পৌঁছে গেলে, সব সময় যে তাঁকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে, তার গ্যারান্টি নেই। তখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়।

কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?
COPD না হওয়ার কারণগুলি এড়িয়ে চলার মাধ্যমে এই অসুখের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সম্ভব। উপসর্গগুলি সামান্য দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন যাতে COPD বেশি বেড়ে না যায়।
_______


বাইট:
wb_kol_01a_copd_day_bite_7203421
চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.