কলকাতা, 2 জুলাই : সীমান্ত সমস্যার পর চিনের জিনিসপত্র বয়কটের বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । সরকারের তরফে চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে । সামগ্রী কিনতে গিয়েও চিনের জিনিসপত্র বর্জন করতে শুরু করেছেন মানুষজন। তবে বাস্তব ছবিটা কোথাও যেন একটু বিপরীত । চিনের জিনিস বয়কট বেজিংয়ের কাছে যতটা উদ্বেগের । ভারতীয় বাজারে যে বিরাট ধাক্কা লাগতে চলেছে, তাও ততটাই উদ্বেগের। বিশেষ করে ভারতীয় ক্রীড়া সরঞ্জামের বাজারে এর বড়সড় প্রভাব পড়বে । শুধু বিক্রেতা নয়, খেলোয়াড়রা নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন ।
কলকাতায় ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রির অন্যতম বড় বিক্রেতা সুজিত ব্রহ্মচারী বলছেন,"চিনের উপর ক্রীড়া সরঞ্জামের বাজার বিরাটভাবে নির্ভরশীল। বিশেষ করে টেবিল টেনিস এবং ব্যাডমিন্টনের মতো খেলায় এই নির্ভরতা অনেকটাই । তাই রাতারাতি ভোলবদল কিংবা স্বনির্ভরতা সম্ভব নয়। সেজন্য সময় লাগবে ।" চার দশকের বেশি সময় ধরে ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রি করে আসছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বক্তব্য, লকডাউনে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত। এর উপর এই সমস্যা তাঁদের অসুবিধা আরও বাড়িয়েছে। বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার টেবিল টেনিস ব্যাট, বল, জুতো,ব্যাডমিন্টন ব্যাট, শাটল চিন থেকে আসে। বাকি দেশ যেমন জার্মানি, জাপানের থেকে পঞ্চাশ লাখ থেকে এক কোটি টাকার সরঞ্জাম আসে । ক্রীড়া সরঞ্জামের 70 শতাংশ আসে চিন থেকে। কুড়ি শতাংশ জার্মানি থেকে আনা হয়। সাত থেকে আট শতাংশ আসে জাপান থেকে । আর এক থেকে দুই শতাংশ দেশীয় সরঞ্জাম বাজারে বিক্রি হয় । সবমিলিয়ে চিনের সরঞ্জামের চাহিদা বাজারে বেশি। কারণ দাম কম। সুজিত ব্রহ্মচারী আরও বলন, "স্বনির্ভরতা দরকার। তবে তার জন্য সময় দিতে হবে। অবস্থা স্বাভাবিক হলে আমি তো চিনের সরঞ্জাম বিক্রি করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।" বর্তমানে তাঁর দোকানে ক্রীড়া সরঞ্জামের 80 শতাংশ চিনের তৈরি । কিন্তু তা এসেছে লকডাউনের আগে। ফলে, দীর্ঘসময় দোকান বন্ধ থাকার একটা ধাক্কা রয়েছে । তার সঙ্গে মজুত মাল বিক্রির দায় । তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে, স্বনির্ভরতার জন্য স্থানীয় দ্রব্যের গুণমান বাড়াতে হবে এবং তাকে টুর্নামেন্টে খেলার ছাড়পত্র দিতে হবে। উলুবেড়িয়ায় তৈরি শাটল দিয়ে কোনও টুর্নামেন্ট খেলা হয় না। কারণ, শাটলটি রাজ্য বা দেশের ব্যাডমিন্টন নিয়ামক সংস্থার অনুমোদিত নয়।
রাজ্য টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা চিনের দ্রব্য ব্যবহার, বাজার ধাক্কা নিয়ে মতামত দেওয়ার আগে পুরো বিষয়টি দেখে নিতে চাইছেন। কারণ, প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই তাঁদের ব্যক্তিগত স্পনসরের দেওয়া ক্রীড়া সরঞ্জামের উপর নির্ভরশীল। ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সচিব এবং প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মান্তু ঘোষ বলেন, "এই সময়ে দাঁড়িয়ে এবিষয়ে আগাম কোনও কিছু বলা মুশকিল। কারণ, খেলা বন্ধ। স্বাভাবিক অবস্থায় যে চাহিদা থাকে তা এখন নেই। আমাদের ভালোমানের খেলোয়াড়দের একটি ব্যাটের রবার মাত্র সাতদিনে শেষ হয়ে যায়। তাঁদের ব্যক্তিগত স্পনসর থাকে, তাই অসুবিধায় পড়তে হয় না। কিন্তু, একজন শিক্ষানবীশের চাইনিজ় রবার প্রয়োজনীয়। এখন সবকিছু বন্ধ হওয়ায় আমাদের অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই ।"
অর্জুন সম্মানে সম্মানিত তিরন্দাজ দোলা বন্দ্য়োপাধ্যায় বলেন, "কোনও সন্দেহ নেই আমাদের ক্রীড়া সরঞ্জামের বাজারে চিনের সংস্থার তৈরি করা সরঞ্জাম অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে। তিরন্দাজির ধনুক, তির কোরিয়া থেকে এলেও তা আদতে চিনের কম্পানির তৈরি । কারণ, কোরিয়ার কম্পানিগুলি স্বল্পমূল্যের শ্রমিকের জন্য চিনের সংস্থাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয় । সময় যত এগোবে সমস্যাগুলি সামনে আসবে। এই অবস্থায় চিন নির্ভরতা ছাড়তে আমাদের দেশীয় জিনিসকে সামনে তুলে ধরতে হবে।" অর্জুন তিরন্দাজের সুর টেবিল টেনিসের প্রখ্যাত কোচ জয়ন্ত পুশিলালের গলায়। "এটাই সুযোগ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার। আমরা যদি প্রয়োজনীয় জিনিস দেশে তৈরি করতে পারি, তাহলে উপকার হবে। এখন আত্মনির্ভরতার সময়, তাই এই সময়টা কাজে লাগানো সঠিক সিদ্ধান্ত। লাদাখের ঘটনার পরে আমি চিনকে বর্জন করার পক্ষে।"
অন্য সময়ে ক্রীড়া সরঞ্জামের জোগান দিতে হিমসিম খাওয়া দোকানি এখন কার্যত মাছি তাড়াচ্ছেন । পয়লা জুন থেকে দোকান খোলা । কিন্তু দিনে সর্বোচ্চ তিনজন ক্রেতা পেয়েছেন তাঁরা। ফোনে অনেকে অর্ডার দিচ্ছেন। সম্ভব হলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে । কিন্তু, তাতেও খুব একটা সাড়া মিলছে বলা যাবে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে যে বড়সড় সমস্য়া হতে পারে, তা আগেভাগেই টের পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জীবন বাঁচাতে তাঁরা বিকল্প পথ বাছার কথা বলছেন । বর্জন বললেই যে বর্জন সম্ভব নয় । ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানিদের বক্তব্যে সেই বিষয়টিও কোথাও যেন ফুটে উঠেছে । অন্যদিকে আবার আত্মনির্ভরতার আহ্বান । সবমিলিয়ে এক স্থিতিশীল পরিস্থিতির অপেক্ষায় সবাই ।