কলকাতা, 18 সেপ্টেম্বর : 13 ডিসেম্বর, 1928 । মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি চিঠি লেখেন হেমপ্রভা দাশগুপ্তকে । হেমপ্রভা ছিলেন একনিষ্ঠ গান্ধিবাদী । বিজ্ঞানী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তর স্ত্রী । চিঠিতে গান্ধি লেখেন, “I shall try to treat Sodepur on the same footings as Sabarmati...The existence of Sodepur is for the shake of khadi , while that of Sabarmati is for experiments in truth , etc. This does not mean that Sabarmati is superior. I merely defined the fields of work of two places . I do desire to make experiments at sodepur , similer to those at sabarmati."( Vol 43, page 367. Complete works of Mahatma Gandhi)
হ্যাঁ, সেই সোদপুর । যাকে গান্ধি নিজের "দ্বিতীয় ঘর" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । এক সময় পশ্চিমবঙ্গে এলে এখানেই থাকতেন তিনি । এখানেই 1939 সালের সেই ঐতিহাসিক বৈঠক । সেই বছর 31 জানুয়ারি সিতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেস সভাপতি হন । ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্চ মাসে ত্রিপুরির অধিবেশনে নানা কারণ দেখিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির 12 জন সদস্য পদত্যাগ করেন । পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু । 27 এপ্রিল সকাল 10 টায় সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানে আসেন মহাত্মা গান্ধি । তখন হাজির ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু । হয় ঐতিহাসিক বৈঠক । 29 এপ্রিল পর্যন্ত বৈঠক হয় । 3 দিনের সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর শেষবারের মতো কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন সুভাষচন্দ্র বসু । বলেন, " সব সমস্যার সমাধান রয়েছে একটি খামে । " ওই দিন বিকেলে কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়্যারে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু ঐতিহাসিক ঘোষণা করেন । কংগ্রেস ছাড়েন তিনি ।
বিজ্ঞানী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন বিজ্ঞানী । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের ছাত্র । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিকেলেই চাকরি করতেন তিনি । ভারতের প্রথম অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র তৈরি করেন তিনি । বেঙ্গল কেমিকেলসে এই যন্ত্র উৎপাদন শুরু হয় । তাঁর ফরমুলাতেই তৈরি হয়েছিল সুলেখা কালি । যা একটা সময় খ্যাতি কুড়িয়েছিল ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে । তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবী ছিলেন প্রবল গান্ধি অনুরাগী । 1921 সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতে তিলক স্বরাজ তহবিল তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন গান্ধি । সেখানে হেমপ্রভাদেবী হাতের সোনার বালা খুলে জমা দিয়েছিলেন । প্রাথমিকভাবে সেই কাজটি ভালোভাবে নেননি সতীশ । প্রাথমিক সেই বিরাগ অনুরাগে পরিণত হয় । অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের লভ্যাংশ থেকে পাওয়া দু'লাখ টাকা দিয়ে তৈরি হয় খাদি প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট । যে ট্রাস্টের সভাপতি হন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ । সতীশবাবু হন ম্যানেজিং ট্রাস্টি । সেই ট্রাস্টের মাধ্যমে 1925 সালের 25 জুন একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খাদি প্রতিষ্ঠান । ওই বছরই সোদপুরে কেনা হয় 34 বিঘা জমি । রেল স্টেশনের পাশেই সেই জমি । গান্ধির জীবনীকার ডি জি তেন্ডুলকর লিখেছেন, " মাত্র নয় মাসের মধ্যে 70 হাজার টাকা ব্যয় করে 30 বিঘা জমির ওপর তৈরি হয় সুদৃশ্য আশ্রম । " 1927 সালের 2 জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধি উদ্বোধন করেন সেই আশ্রমের । তখন ট্রেনেই সোদপুরে আসতেন গান্ধিজি ।
সেই সময় “প্রবাসী" পত্রিকায় আশ্রমের বিস্তারিত বিবরণ এবং ছবি ছাপা হয়েছিল । সেই বিবরণ থেকে জানা যায় , প্রতিষ্ঠানটির মূল প্রবেশপথ সাঁচি স্তূপের তোড়ণের আকারে বানানো হয়েছিল । তারই মধ্যে ব্যারাকের আদলে কয়েকটি বাড়ি ছিল । ছিল একটি রন্ধনশালা ও কর্মীদের আবাসন । সেখানে গান্ধি উদ্বোধন করেছিলেন একটি পাকাঘরের । সেটি U আকৃতির ছিল । এখন শুধু সেইটিই অবশিষ্ট আছে । স্বাধীনতার পর বাকি অংশটুকু বিক্রি করে দেয় ট্রাস্ট ।
ফিরে আসা যাক সেপ্টেম্বর 2019 - এ । সোদপুর গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের মাঝে আগাছা ভরা একখণ্ড জমি । লোহার গ্রিলের চারপাশে ভগ্নস্তূপের মধ্যে U আকৃতির একটা বাড়ি । জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে। সেখান থেকে উঁকি মেরে তাকালে দেখা যায়, টালির চালের ভেঙে পড়া সেই বাড়ি । মূল ফটকের সামনে রাখা আছে স্টোন চিপের স্তূপ । সেখান থেকে উঁকি মারলে দেখা যায় গান্ধির বিবর্ণ স্ট্যাচু । খাদি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক কেয়ারটেকার আছেন । বিনা পারিশ্রমিকের সেই কেয়ারটেকার রোজ খোলেন না আশ্রম । সোদপুরবাসীর অনেকে জানেনই না, ওই একখণ্ড ভূমিতেই পা পড়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বরেণ্য ব্যক্তিদের । গান্ধিজি নিজে এই ভূমিকে বলে গেছিলেন তাঁর " দ্বিতীয় ঘর । "
1927 সালে জানুয়ারিতে গান্ধিজি সোদপুর খাদি আশ্রমের উদ্বোধন করে সেখান থেকেই ট্রেনে যান কুমিল্লায় অভয় আশ্রমে । তারপর দু'বছর সোদপুরে পা রাখেননি তিনি । তবে হেমপ্রভাদেবী এবং সতীশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল । 1929 সালের 3 মার্চ তিনি কলকাতায় এসে সোদপুরের খাদি আশ্রমে বসবাস শুরু করেন । এই সময়কালেই নেওয়া হয়েছিল বিদেশি বস্ত্র বয়কটের সিদ্ধান্ত । গান্ধিজির সেই ঘোষণার পরেই বিদেশি বস্ত্র আগুনে নিক্ষেপ শুরু করে জনতা । 5 মার্চ সোদপুরের আশ্রমে হাজির হয় ব্রিটিশ পুলিশ । উদ্দেশ্য ছিল গান্ধিজিকে গ্রেপ্তার । গ্রেপ্তার বরণ করেন গান্ধি । কিন্তু সেই দিনই তাঁর রেঙ্গুনে যাওয়ার কথা ছিল । সেই কারণে ব্যক্তিগত জামিনে তাঁকে মুক্ত করা হয় ।
এরপর প্রায় 8 বছরের বিরতি । এইসময় কলকাতাতেই আসেননি গান্ধি । 1937 সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় আসেন গান্ধিজি । 10 এপ্রিল কিছু সময়ের জন্য এসেছিলেন সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানে । তারপর আসেন 1939 সালের জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে । পরে 1945 সালের 1 ডিসেম্বর ফের সোদপুরে আসেন গান্ধিজি । 7 ডিসেম্বর থেকে 10 ডিসেম্বর পর্যন্ত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় খাদি প্রতিষ্ঠানেই । সোদপুর থেকেই 18 ডিসেম্বর গান্ধিজি যান শান্তিনিকেতনে । ফিরে আসেন 20 ডিসেম্বর । পরে মেদিনীপুর সফর শেষে ফের 3 জানুয়ারি সোদপুরে আসেন গান্ধিজি । 5 এবং 6 জানুয়ারি মহত্মার উপস্থিতিতেই সেখানে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন । 19 জানুয়ারি সোদপুর থেকে তৎকালীন মাদ্রাজে রওনা দেন গান্ধি ।
এরপর গান্ধির সোদপুর আগমন অত্যন্ত বেদনাদায়ক । তখন হয়ে গেছে মহম্মদ আলি জিন্নাহর ডাকে ডাইরেক্ট একশন ডে । হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আবহে হিংসার আগুনে জ্বলছে গোটা বাংলা । 29 অক্টোবর দিল্লি থেকে সোদপুরে আসেন গান্ধি । 31 অক্টোবর সোদপুরে মহত্মার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তৎকালীন বাংলার প্রিমিয়ার তথা মুসলিম লিগ নেতা হোসেন সুরাবর্দি এবং গভর্নর মিস্টার কে সি । দীর্ঘ বৈঠক হয় সেখানে । সরকারি নানা টালবাহানার পর 6 নভেম্বর সোদপুর স্টেশন থেকেই নোয়াখালির উদ্দেশে রওনা হন গান্ধি । দীর্ঘ 5 মাস পূর্ববঙ্গের নানা স্থানে কাটানোর পর সোদপুরে ফিরে আসেন 3 মার্চ । 4 মার্চ সোদপুরের তাঁর সঙ্গে ফের বৈঠক করতে আসলেন সুরাবর্দি । 5 মার্চ তিনি বিহারের উদ্দেশে রওনা হন সোদপুর থেকেই ।
কয়েক মাস পরেই তিনি ফের সোদপুরে আসেন । সেবার তার সফরসঙ্গী ছিলেন নাতনি মনু গান্ধি, ওয়ার্ধা আশ্রমের বিষেনজি, ডঃ অমিয় চক্রবর্তী সহ অনেকেই । 9 মে শরৎচন্দ্র বসু সোদপুরে গান্ধির সঙ্গে দেখা করেন । 10 মে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন আবুল কাশেম । 12 মে সুরাবর্দির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন গান্ধি । তখন বাংলা ভাগের কার্যকলাপ চলছে পুরোদমে । সেদিনের আলোচনায় বিষয় ছিল ইউনাইটেড বেঙ্গলের পরিকল্পনা । নেতাজির মেজদা শরৎচন্দ্র বসু বাংলা ভাগের পরিকল্পনা আটকাতে সুরাবর্দির সঙ্গে মিলে ইউনাইটেড বেঙ্গল তৈরির পরিকল্পনা করেন । এরপর গান্ধিজির সঙ্গে কথা বলতে আসেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি । তিনি বাংলা ভাগের জন্য জোরদার সাওয়াল করেন ।
সোদপুরে গান্ধি 1947 সালের 9 অগাস্ট শেষবার এসেছিলেন । সেবার তিনি ছিলেন 13 অগাস্ট পর্যন্ত । তার দু'দিন পরেই স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ । শুধুমাত্র জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, সুরাবর্দিরাই নন, ইতিহাস বলছে সোদপুরের এই আশ্রমে পা রেখেছেন সরোজিনী নাইডু, পদ্মজা নাইডু, ড: সুশীলা নায়ার, ক্ষিতীশ চন্দ্র দাসগুপ্ত, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, প্যারেলাল নায়ার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সহ আরও অনেকে । 1948 সালের 30 জানুয়ারি গান্ধির মৃত্যুর পর শেষ হয়ে যায় সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক গুরুত্ব । 1964 সালে প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ জমি নিয়ে তৈরি হয় সরকারি আবাসন । তারই এক কোণে উজ্জ্বল ইতিহাসের স্মৃতি বুকে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান ।
UNESCO -র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের প্রস্তাবিত তালিকায় রয়েছে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান নাম । রাজ্য সরকারের হেরিটেজ হিসেবেও চিহ্নিত এই প্রতিষ্ঠান । কিন্তু তারপরেও এর রক্ষণাবেক্ষণে কোন উদ্যোগে চোখে পড়েনি । বাড়ির কেয়ারটেকার বলেন, “ আসলে আমাদের কোনো ফান্ড নেই । নিজেদের টাকায় যেটুকু পারি রক্ষা করার চেষ্টা করি ।" গান্ধি গবেষক ড: শেখর শেঠ বলেন, " আমরা রাষ্ট্রপতিকে পর্যন্ত চিঠি লিখেছি । জানিয়েছি কেন্দ্রীয় সরকারকে । রাজ্য সরকারের কাছেও আছে তথ্য । মাঝে 5 লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল । তা দিয়ে যেটুকু পারা যায় সংস্কার হয়েছে । কিন্তু এখন আর কারও উদ্যোগ নেই এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে । "
স্থানীয় বিধায়ক নির্মল ঘোষ এবিষয়ে বলেন, " আমরা চেষ্টা করছি এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য । রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়েছে বটে । কিন্তু ফান্ড একটা বড় সমস্যা । " প্রতিশ্রুতি আছে, ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায় । তারপরেও একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে সোদপুরের গান্ধি আশ্রম ।