কলকাতা, 6 জুলাই : সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। কলেজ স্ট্রিটে ট্রামলাইনের উপর ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে ভয়ংকরভাবে জখম হয়েছেন ছাত্রনেতা বিমান বসু । বিমান বসুকে বাঁচাতে গিয়ে কোমরে পুলিশের মোটা রুলের বাড়ি খেলেন আর এক ছাত্রনেতা । শ্যামল চক্রবর্তী। আজ তাঁর মৃত্যুতে যেন এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান ঘটল। তাঁর এভাবে চলে যাওয়াটা এখনও মেনে নিতে পারছেন না সতীর্থরা । ৭৬ বছর বয়সে শেষ পর্যন্ত কোরোনার কাছে পরাজিত আমৃত্যু অপরাজিত, লড়াকু এক নেতা ।
১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্ম । তবে জন্মদিনের কথাটা মুখ ফুটে কখনও কাউকে বলতেন না। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা অবিভক্ত যৌথ পরিবারে খুব দারিদ্র্যের মধ্যেই ছেলেবেলা কেটেছিল । ওপার বাংলা থেকে প্রথমে চাকদায় কিছুদিন থাকেন । পরে দমদম নলতা রোডে বসবাস শুরু করে তাঁর পরিবার। ১৯৫১ সালে তিনি দমদম রায়বাহাদুর বৈদ্যনাথ ইন্সটিটিউশনে ভরতি হন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে ডাবল প্রমোশন পেয়ে ১৯৫৪ সালে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ছাত্রাবস্থা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল শ্যামলের । স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনেও লেখা দিতেন। সেই স্বভাব আজীবন থেকে গেছিল । দেওয়াল পত্রিকায় লেখার কাজ করতেন ছোটোবেলা থেকে। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ একাধারে প্রাবন্ধিকও ছিলেন।
১৯৫৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর দমদম মতিঝিল কলেজে ভরতি হন। এখান থেকেই ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন । এরপর বিদ্যাসাগর কলেজ । ১৯৬৬ সালে সেখান থেকে স্নাতক হন। ছোটবেলা থেকেই বাবা সুশীল চক্রবর্তী এবং মা অন্নপূর্ণা দেবীকে বামপন্থী ভাবধারায় দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন শ্যামল। এরপর সংসারজীবনে প্রবেশ। বিয়ে করেন ছাত্র আন্দোলন এবং পরে মহিলা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী শিপ্রা ভৌমিককে। ১৯৮২ সালে পত্নীবিয়োগ হয়। একমাত্র কন্যা অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তী। পরের দিকে মানিকতলার হাউজ়িং এস্টেটে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন শ্যামল চক্রবর্তী।
আরও পড়ুন : কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত শ্যামল চক্রবর্তী
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন । ১৯৭০ সালে SFI গঠিত হয় । তারপর থেকে SFI-র রাজ্য নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন । ১৯৭৩ সালে শিবপুর সম্মেলনে SFI-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন । ছ'বছর অর্থাৎ 1979 সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বেই ছিলেন। SFI-র সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বভারও সামলেছিলেন । ১৯৭৮ সালে শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলন থেকে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে রাজ্য সম্মেলন হয় । সেখানে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের CPI(M) বিধায়ক সুহৃদ বসু মল্লিকের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে এই কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শ্যামল চক্রবর্তী । প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন। সে বারই রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী হন । ১৯৮২ সালের বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রিসভার সদস্য হন। ১৯৮৭ এবং ১৯৯৯ সালে পরপর মানিকতলা থেকে জয়ী হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক জগতের বড় ক্ষতি : মমতা
২০০২ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন শ্যামল চক্রবর্তী । জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পরিবহন শিল্প, বিদ্যুৎ শিল্প সহ কয়েকটি ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। CITU-র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি হিসেবেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে গ্রামীণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের সংগঠনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে একটি প্রচার পুস্তিকাও লিখেছিলেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন শ্যামল চক্রবর্তী। এরপর ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে রাজ্যসভার সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল অবধি সাংসদ ছিলেন। সুবক্তা, সুলেখক এবং প্রাবন্ধিক শ্যামল চক্রবর্তী ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন "৬০-৭০ ছাত্র আন্দোলন" শীর্ষক বইয়ে। "কাশ্মীর অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ", "সমাজতন্ত্র কী এবং কেন", "তিন প্রসঙ্গ", "গরু ও ত্রিশূল", "আর্যরা কি ভারতের আদিম অধিবাসী", "ঝড়ের খেয়া" সহ একগুচ্ছ বই লিখেছিলেন তিনি। বেশ কয়েকদিন পার্টির প্রকাশনা কেন্দ্র ন্যাশনাল বুক এজেন্সির পরিচালনার দায়িত্ব সামলেছেন।
বিমান বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, শৈলেন দাস গুপ্ত এবং অনিল বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। তাঁর লড়াকু মানসিকতা আজও সতীর্থদের উদ্বুদ্ধ করে চলে। আজ তাঁর চলে যাওয়া যেন এক শূন্যতা তৈরি করল । অবসান ঘটল এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের।