কলকাতা, 16 সেপ্টেম্বর: 10 বছর ধরে পারকিনসন্সে আক্রান্ত তিনি । চিকিৎসা চলছিল । একসময়, ওষুধে সেভাবে আর কাজ না হওয়ায়, ব্রেন পেসমেকার বসানো হয়েছিল তাঁর । সমস্যা দেখা দেয় তারপরেও । স্থির হয়ে থাকতে পারতেন না । অনেকটা নাচের মতো মুভমেন্ট । হাত, পা শক্ত হয়ে যেত । একসময় কথাও বন্ধ হয়ে যায় তাঁর । কলকাতার বাসিন্দা বছর ৪৫-এর এই রোগী একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার । অবশেষে, মল্লিকবাজারে বেসরকারি একটি হাসপাতালের চিকিৎসায় এখন কথা বলতে পারছেন তিনি । অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও কিছুটা মিটেছে । ওষুধ পাম্পের মাধ্যমে রোগীর শরীরে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন চিকিৎসকরা । তার জেরেই এই সাফল্য পেলেন তাঁরা । পারকিনসন্সের চিকিৎসায় এই ওষুধ এবং পাম্পের ব্যবহার পূর্ব ভারতে এই প্রথম বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা । হাসপাতালের চিকিৎসক হৃষিকেশ কুমার জানিয়েছেন, এই ওষুধ ইঞ্জেকশনের মতো পাম্পের মাধ্যমে দেওয়া হয় । চিকিৎসকের পরামর্শ মতো এই পাম্পে সেট করে দেওয়া হয় কত সময় ধরে এবং কতটা পরিমাণে ওষুধের প্রয়োজন । এই পাম্প থেকে একটি টিউবের মাধ্যমে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয় রোগীর শরীরে । টিউবের মাথায় রয়েছে নিডল । এই নিডল পেটে সেট করে দেওয়া হয় ।
বেসরকারি ওই হাসপাতালের চিকিৎসক পূর্বা বসু বলেন, "এই রোগী যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন তিনি 10 বছর ধরে পারকিনসন্সে ভুগছেন । ব্রেন সার্জারিও হয়েছিল । একটি স্টিক নিয়ে তাঁকে হাঁটতে হত । একা হাঁটতে পারতেন না । সমস্যায় পড়তে হতো । রোগীর তখন ডিস্কাইনেশিয়াও দেখা দিয়েছিল। অর্থাৎ, স্থিরভাবে তিনি থাকতে পারতেন না । সব সময় নড়াচড়া করতেন । নাচের মতো মুভমেন্ট । মাঝেমধ্যে হাত-পা শক্ত হয়ে যেত, কথা বলতে পারতেন না ।" তাঁর কথায়, "এই রোগীকে আমরা দু' বছর ধরে দেখছি । শেষবার যখন আমাদের কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন তাঁর 15 দিন আগে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । গলার স্বর কমে আসে, কথা জড়িয়ে যায় ৷ এটি পারকিনসন্স রোগের একটি উপসর্গ । ধীরে ধীরে কথা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছিল । তখন অ্যাপোমরফিন ইনজেকশন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।"
এই ওষুধ ব্যবহারের জন্য পাম্প ব্যবহারের বিষয়ে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেন? পূর্বাদেবী বলেন, "রোগীর বয়স কম । তার কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল । অসুখের লক্ষণগুলি আগের ওষুধের মাধ্যমে কন্ট্রোল করা যাচ্ছিল না । ব্রেন পেসমেকার কাজ করলেও তাঁর কথা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছিল না ৷ আমাদের কাছে একটাই উপায় ছিল, পাম্পের মাধ্যমে রোগীর কথা ফিরিয়ে আনা যায় কি না । মূলত রোগীর কথা ফিরিয়ে আনার জন্যই এই পাম্প ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৷ পাশাপাশি রোগীর অন্যান্য শারীরিক সমস্যার উন্নতির বিষয়টিও নজরে ছিল ।" তিনি জানান, পাম্পের মাধ্যমে ওষুধের ট্রায়াল দেওয়ার পর দেখা যায় রোগীর কথা ফিরে আসছে । এরপরে যাতে সব সময় কথা বলতে পারেন তিনি তার জন্য পাম্প ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৷ রোগী যতক্ষণ কাজকর্মের মধ্যে থাকেন, ততক্ষণ পাম্পের ব্যবহার করা হচ্ছে । যতক্ষণ পাম্প চালু থাকে ততক্ষণ স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছেন ।" পূর্বাদেবীর বক্তব্য, "ডিস্কাইনেশিয়াও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে । শরীরে ওষুধের কম-বেশি মাত্রার উপর ডিস্কাইনেশিয়ার সমস্যা দেখা দেয় । পাম্পের মাধ্যমে ওষুধ দিলে এই সমস্যা থাকে না ।"
পূর্বাদেবীর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন হাসপাতালের অপর চিকিৎসক হৃষিকেশ কুমার । তিনি বলেন, "গত ছয় মাস ধরে তিনি কথা বলতে পারছিলেন না । এর পরে, নতুন একটি ওষুধ দেওয়ার ভাবনা চিন্তা করলাম আমরা । কয়েক মাস আগ থেকে এই ওষুধটি এদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে । এই ওষুধ পাম্পের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় ।" তিনি আরও বলেন, "পাম্পের মাধ্যমে এই ওষুধ আমরা দেওয়া শুরু করি । এই ওষুধ ব্যবহারের ফলে এখন কথা বলতে পারছেন তিনি । হাঁটাচলাতেও উন্নতি হয়েছে । পূর্ব ভারতে এই ওষুধ এবং এই পাম্পের ব্যবহার এই প্রথম । দক্ষিণ ভারতে কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছে ।" রোগী কেমন আছেন এখন? এই চিকিৎসক বলেন, "আগের থেকে এখন অনেক ভালো আছেন । ভালোভাবে কথা বলতে পারছেন । তাঁর হাঁটাচলায় উন্নতি হয়েছে ।"
সারাজীবন কি এই ওষুধ ব্যবহার করতে হবে? চিকিৎসক হৃষিকেশ কুমার বলেন, "পারকিনসন্স হল পার্মানেন্ট ডিজ়অর্ডার । নার্ভ ডিজেনারেশন । এই অসুখ সম্পূর্ণ সেরে যায় না । নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় । পারকিনসন্স চিকিৎসায় নতুন কিছু না আসা পর্যন্ত এই ওষুধ এবং পাম্পের ব্যবহার এই রোগীকে সারাজীবন চালিয়ে যেতে হবে ।" তিনি বলেন, "5-10% ক্ষেত্রে কম বয়সিদের মধ্যে দেখা যায় । এক্ষেত্রে রোগীর পারকিনসন্স যে বয়সে ধরা পড়েছে, সেটা আনকমন । সাধারণত ৬০-এর বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে পারকিনসন্স দেখা দিতে পারে । কিন্তু, 5 থেকে 10 শতাংশ ক্ষেত্রে অল্পবয়সিরা আক্রান্ত হতে পারেন ।"
অল্পবয়সে কেন পারকিনসন্স হতে পারে? তিনি বলেন, "এখনও পর্যন্ত কারণ জানা যায়নি ৷ তবে কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে । জেনেটিক ফ্যাক্টর হতে পারে । জিনের অস্বাভাবিকতার কারণেও হতে পারে । এই ফ্যাক্টর আচমকা কাজ করতে পারে অথবা বংশগতভাবে হতে পারে । এক্ষেত্রে ফ্যামিলি হিস্ট্রিতে পারকিনসন্স কারও নাও থাকতে পারে । জেনেটিক ফ্যাক্টর ছাড়া এখন দূষণের কারণে পারকিনসন্সে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে ।" তিনি বলেন, "এমন কিছু পার্টিকেলস আছে, দূষণের মাধ্যমে যেগুলি ব্রেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে । এর ফলে পারকিনসন্স হতে পারে । খাবারের মাধ্যমেও পারকিনসন্স হতে পারে । খাবারের মধ্য দিয়ে কোনও খারাপ কেমিকাল শরীরে প্রবেশ করলে, পারকিনসন্স হতে পারে । পারকিনসন্সে চারটি উপসর্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ । যার মধ্যে রয়েছে স্লোনেস । যে কাজ আধ ঘণ্টায় করেছিলেন ব্যক্তি, পারকিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে সেই কাজ করতে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যাচ্ছে । এর পরে রয়েছে ট্রেমর । এক্ষেত্রে হাত-পা কাঁপতে পারে । হাঁটাচলায় অসুবিধা হতে পারে, কথা জড়িয়ে যেতে পারে । রোগী খুব স্লো চলবেন । কথা জড়িয়ে যেতে পারে, রিসেন্ট মেমোরি কমে যেতে পারে । সকালে কী করেছেন, রোগী তা ভুলে যেতে পারেন বিকালে । আর রয়েছে স্টিফনেস । খুব স্টিফ হয়ে পড়তে পারে বডি ।"
চিকিৎসা বলতে কী রয়েছে? চিকিৎসক হৃষিকেশ কুমার বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত পারকিনসন্স সেরে ওঠে না । ধীরে ধীরে সমস্যা বাড়তে থাকে। সাময়িক উন্নতির জন্য ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে । তবে এটা সম্পূর্ণ সেরে ওঠে না । ব্রেনে ডোপামেন নামে কেমিকেলের অভাবে ব্রেন ড্রাই হতে থাকে । এ জন্য বাইরে থেকে ডোপামিন দিতে হয় ওষুধের মাধ্যমে । খাওয়ার ওষুধ অর্থাৎ, ওরাল ডোপামেন কোনও রোগীর ক্ষেত্রে সারা জীবন কাজ করে না । কয়েক বছর পরে এফেক্ট করে না । ব্রেন পেসমেকারের মাধ্যমেও চিকিৎসা হয় । তৃতীয় উপায় পাম্পের মাধ্যমে ইনজেকশন আকারে ওষুধ দেওয়া ।" তিনি বলেন, "বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, মুম্বাই-তে এই পাম্পের ব্যবহার শুরু হয়েছে । কলকাতা তথা পূর্বভারতে এই প্রথম হল । পশ্চিমের দেশগুলিতে পারকিনসন্স দেখা যেত । এখন এদেশে পারকিনসন্সের অনেক রোগীর দেখা মিলছে । আগামী 20 বছরে পারকিনসন্সে আক্রান্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে । কলকাতায় অন্ততপক্ষে 15 থেকে 20 হাজার পারকিনসন্সের রোগী আছেন । এর মধ্যে 10 হাজারের রোগ নির্ণয় হয়নি ।" একইসঙ্গে তিনি বলেন, "পারকিনসন্সের প্রাথমিক চিকিৎসায় ওরাল মেডিসিন সব থেকে ভালো । এরপরে মেডিসিন ভালো কাজ করে না । আধ ঘন্টা অথবা, এক ঘন্টা কাজ করে । প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর ওষুধ নেওয়া সম্ভব নয় । এক্ষেত্রে এই পাম্প ভালো কাজ করে । যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ ওষুধ শরীরে যেতে থাকবে এই পাম্পের মাধ্যমে ।"