কলকাতা, 28 জুন : সারদা, রোজ় ভ্যালি, আইকোর ইত্যাদি দিয়ে শুরু করে হালের দেবাঞ্জন দেবের ভুয়ো সংস্থা । কেন বারবার পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতাই হয়ে উঠছে এই সমস্ত ভুয়ো সংস্থার বাড়বাড়ন্তের ভূমি ? অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ দু'টি । প্রথম কারণটি হল, উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বহুজাতিক এবং দেশীয় বড় সংস্থার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনীহার কারণে রাজ্যের অর্থনৈতিক অধোগতি । দ্বিতীয় কারণটি হল, বিশেষ ক্ষেত্রে রাজ্যেরই বা বলা ভাল রাজ্যের শাসক শ্রেণির একাংশের পরোক্ষ সহায়তা ।
বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু সান্যাল মনে করছেন, এই রাজ্যে বাম আমল থেকেই একের পর এক ভুয়ো সংস্থার প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে । ইটিভা ভারতকে তিনি বলেন, "তার একটা কারণ অবশ্যই রাজ্যে চাকরি-বাকরির সুযোগ সেভাবে না থাকা । আর ধারাবাহিকভাবে বড় শিল্পের অনীহার কারণে একটা বিনিয়োগের ফাঁক থেকেই গিয়েছে ৷ ফলে অর্থনৈতিক অধোগতি হয়েছে ধারাবাহিকভাবে । এই ফাঁকের সুযোগ নিয়েছে এই সমস্ত প্রতারক মানুষগুলি এবং ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলি । আর দ্বিতীয় কারণ হল সরষের মধ্যেই তো ভূত । রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাবেই এই ধরনের প্রতারণার বাড়বাড়ন্ত হয় । আর এই নিয়ন্ত্রণ অভাবের একটা বড় কারণ এর সঙ্গে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা যুক্ত থাকা । ফলে কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে ? সরষের মধ্যে ভূত থাকলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয় । এক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে বা হচ্ছে ৷"
"রাষ্ট্রের নামে প্রতারণা রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া হয় না "-- এমনি মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক শান্তনু বসু । "রাষ্ট্রের সাহায্য না পেলে দেবাঞ্জন দেব এসব প্রতারণার কাজ করতে পারত না । একজন ব্যক্তি পৌরসভার নথি জাল করছে, নেতা-মন্ত্রীদের তার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করছে, এমনকি সরকারি টেন্ডারের কায়দায় টেন্ডার ডেকে কর্মী নিয়োগ করছে । এটা প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া কীভাবে সম্ভব ? এর পিছনে অবশ্যই এমন কোনও মাথা আছে যা প্রকাশ্যে আসছে না । সবচেয়ে বড় কথা, আমার ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে হচ্ছে, শুধু শহর কলকাতায় নয়, এই প্রতারণার জাল আরও অনেক দূর বিস্তৃত । যেহেতু সেখানে মিডিয়ার প্রবেশ করছে না তাই সেগুলি প্রকাশ্যে আসছে না ।" শান্তনু বসু বলেন।
আরও পড়ুন : সারদার সুদীপ্ত সেনের পথে হেঁটেই কি প্রতারণার জাল বিস্তার দেবাঞ্জনের ?
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্টার রাজা গোপাল ধরচক্রবর্তী বলেছেন যে, এই ঘটনায় যতই বলা হোক দেবাঞ্জন দেবের কুকীর্তির কথা, আরও অনেকেই এর পিছনে রয়েছেন এটা নিশ্চিত । তিনি বলেন, "রাজ্যের বিরোধী দল যে কথা বলছে তাকে একদমই উপেক্ষা করার বিষয় নয় । কারণ এর সঙ্গে রাজনীতি ও প্রশাসনের আরও অনেকের নাম জড়িত থাকতে পারে । একমাত্র বৃহত্তর প্রেক্ষিতে গিয়ে তদন্তই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে পারে ।"
অন্যদিকে, বিশিষ্ট আইনজীবী তথা কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষের মতে, এই ধরনের জালিয়াতির ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । অরুণাভবাবু বলেন, ''এর দায় শাসকদল ও সরকার এড়াতে পারে না । সবচেয়ে বড় কথা যদি হাইকোর্টে এ ধরনের ঘটনা ঘটত, তাহলে প্রধান বিচারপতিকে এর দায় নিতে হত । একইভাবে এই জালিয়াতির ঘটনায় দায় তৃণমূলের সরকারকে নিতে হবে । সরকার যদি প্রকৃত এই ধরনের প্রচেষ্টা বন্ধ করতে চায় তাহলে যারা এর সঙ্গে যুক্ত যারা তাদের সকলকে চিহ্নিত করা দরকার । তবে সেটা হবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকছেই । "
আরও পড়ুন : Fake Vaccination Case : ভুয়ো সার্টিফিকেট দিয়ে নিজের মামার সঙ্গে প্রতারণা দেবাঞ্জনের !
ভুয়ো ভ্যাকসিন-কাণ্ড নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল । রাজ্যের শাসক এবং বিরোধী পক্ষ পরস্পরের প্রতি এই নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত । আসলে এমতাবস্থায় এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যে ভ্যাকসিন এর মত একটি জীবনদায়ী বিষয় নিয়ে প্রতারণা কীভাবে পুলিশ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে সম্পন্ন হল । এখন প্রশ্ন উঠেছে, কতদিন আর পশ্চিমবঙ্গ হয়ে থাকবে সুদীপ্ত সেন, গৌতম কুণ্ডু এবং দেবাঞ্জন দেবের মতো প্রতারক এবং ভুঁইফোঁড়দের আঁতুর ? কতদিন আর প্রশ্রয় পাবে এই সব ভুঁইফোঁড়রা রাজনৈতিক মহলের একাংশের ? আর কবেই বা বিনিয়োগের ফাঁড়া কাটিয়ে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখবে এই পশ্চিমবঙ্গ ?