কলকাতা, 24 জুলাই : শিল্প না কৃষি ? রাজ্যের অর্থনৈতিক তথা সার্বিক উন্নয়নে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ? বাংলার মসনদে শাসক দল বদলালেও ফের একই প্রশ্নে টাটা শিল্পগোষ্ঠীকে স্বাগত জানানো হয়েছে সম্প্রতি ৷ কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে উঠে আসবে সিঙ্গুর আন্দোলন ৷
2006 সাল ৷ পশ্চিমবঙ্গে বাম আমল, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ হুগলি জেলার সিঙ্গুরে প্রায় 1000 একর জমি নিয়ে টাটা গোষ্ঠী তুলনায় কম দামের ন্যানো গাড়ির কারখানা তৈরি করবে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার ৷ বহু কৃষক তাঁদের ফসলি জমি দিতে রাজি ছিল না তখন ৷ স্বভাবত বিরোধী দল এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনে নামল ৷ আন্দোলন রুখতে কার্যত যুদ্ধের আকার নিয়েছিল বাম-তৃণমূল লড়াই ৷ 24 জুলাই এর প্রতিবাদে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করা হয় ৷ প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেপ্টেম্বর মাসে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করে টাটা গোষ্ঠী ৷ 25 সেপ্টেম্বর জমি গ্রহণের বিরুদ্ধে মাঠে নামে 400 জনেরও বেশি সিঙ্গুরবাসী, 78 জন সমাজকর্মী ৷ তাঁদের মধ্য়ে মহিলা, পুরুষ এমনকি শিশুরাও ছিল ৷ তাদের আটকাতে ব়্যাফ নামানো হয় ৷ পুলিশ লাঠিচার্জ করে ৷ গ্রেফতার হন সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেকে ৷ বিডিও অফিসে পুলিশ অত্যাচারে মারা যান রাজকুমার ভুল ৷ সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রথম শহিদ তিনি ৷ আন্দোলন ছড়িয়েছিল সারা দেশে ৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে টাটা গোষ্ঠীকে চাষের জমি থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান ৷ 17 নভেম্বর সিঙ্গুর থেকে ফিরে এসে মেয়ো রোডে অবস্থান শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ রাজ্য সরকার এই প্রস্তাবে সায় না দেওয়ায় তিনি 4 ডিসেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ লাগাতার 25 দিন অননশ চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ৷ প্রাণ যায় যাক, কিন্তু হার মানবেন না ৷
আরও পড়ুন : সিঙ্গুর আন্দোলনের 13 বছর পর মমতার মন্ত্রী টাটাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত
বিক্ষোভ সত্ত্বেও টাটা গোষ্ঠী কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছিল ৷ কিন্তু পরে পিছু হঠতে হয় টাটাকে ৷ তারা গুজরাতে সরিয়ে নিয়ে যায় ন্যানো কারখানা ৷ হার মানতে হয়েছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারকে ৷ এরপর মাত্র আড়াই বছর বাংলা শাসনের শেষ সুযোগ পেয়েছিল ব্রামফ্রন্ট সরকার ৷ 2011-এ বিধানসভা নির্বাচনে পরিবর্তন এল রাজ্যে, তার অন্যতম কারণ সেদিনের সিঙ্গুর আন্দোলনে কৃষকদের জয় তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান ৷ আর টাটা গোষ্ঠীর কারখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া ৷
প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা দিয়েছিলেন জমি ফেরত পাবে কৃষকরা ৷ এবার একুশের নির্বাচনে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফিরলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সিঙ্গুর আন্দোলনের পর কেটে গিয়েছে 13 বছর ৷ রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বাংলায় সেই টাটা গোষ্ঠীকে শিল্পে বিনিয়োগে আহ্বান জানিয়েছেন ৷ তাহলে সেদিন কেন আন্দোলন করেছিলেন তাঁরা ?
এই প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, টাটা শিল্পগোষ্ঠীকে এই রাজ্যে স্বাগত । তারা কখনওই টাটার শিল্পগোষ্ঠীর বিপক্ষে ছিলেন না, বরং বিরোধিতা ছিল বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে ৷ এ নিয়ে শিল্পমন্ত্রীকে কটাক্ষ করতে ছাড়লেন না বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী ৷ তিনি বলেন, "যা যা ওরা বেঠিক করেছেন, তা আজ হোক বা কাল হোক, ওদের বুঝতে হবে । মানুষও বুঝবে । কথাটা শুধু টাটার নয় ৷ পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের যে প্রকল্প করা হচ্ছিল, কোথাও সিঙ্গুর হতে পারে, কেমিক্যাল হাব হতে পারে, রঘুনাথপুর হতে পারে, নানাবিধ শিল্প হতে পারত । পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে 'ডেস্টিনেশন ওয়েস্টবেঙ্গল' অ্যাঙ্গেল নিয়ে চলছিল । আইটি সেক্টর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল । বারোটা বাজানোর দায় তৃণমূল কংগ্রেসের ।"
আরও পড়ুন : রাজ্যের স্বার্থে টাটার সঙ্গে হাত মেলানো কি মমতার বিলম্বিত বোধদয় ?
এর সঙ্গে তিনি আরও জানিয়েছেন, আজকে তৃণমূলকে ঘুরিয়ে পুরনো কথা স্বীকার করতে হচ্ছে । দশক সর্বনাশ হয়ে গেছে বাংলার । রাজ্যের যুবকরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পরিযায়ী । কাজ নেই । তিনি বলেন, "যে সর্বনাশ ওরা করেছে, তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেতে সময় লাগবে । ওরা বুঝলে কী লাভ হবে জানি না । বুঝবেন কি না, তা জানি না । সর্বনাশ যা করার করে দিয়েছেন ।"
উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হওয়া রুমানা সুলতানাকে "মুসলিম কন্যা" হিসেবে সম্বোধন করায় বিতর্ক অব্যাহত । তাঁকে রাজ্য সরকার "কন্যাশ্রী"র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । এই প্রসঙ্গেও তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করে সুজন বলেন, "মেয়েটির কৃতিত্বের তুলনা, তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন । তাঁর যে গৌরব বা গরিমা, তার তুলনায় কন্যাশ্রীর বাণিজ্যিক দূত বা কোনও প্রকাশনার বাণিজ্যিক দূত করে মেয়েটিকে খাটো করা হয় । সরকার ছেঁদো মানসিকতা নিয়ে চলছে ৷" একে দুর্ভাগ্যজনক বলে সমালোচনা করেছেন সুজন ।