কলকাতা, 15 জুন: পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিরাপত্তার প্রশ্নে কলকাতা হাইকোর্টে বড়সড় ধাক্কা খেল নির্বাচন কমিশন ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৷ বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের নির্দেশ, পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের সমস্ত জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে ৷ 48 ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত ।
এর আগে মঙ্গলবার পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়েছিল প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ ৷ সেই রায়ের একটি অংশে রাজ্যের স্পর্শকাতর জেলাগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয় ৷ কিন্তু কমিশন যেহেতু স্পষ্ট করে এখনও স্পর্শকাতর জেলা বলে কোনও কিছু নির্ধারণ করেনি, তাই ওই অংশের সংশোধনী চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় রাজ্য সরকার ৷ অন্যদিকে আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে পালটা মামলা দায়ের করা হয় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর তরফে ৷
বৃহস্পতিবার দু’টি মামলার শুনানি হয়৷ শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় প্রধান বিচারপতি টিএস শিবাজ্ঞানমকে ৷ আদালতের নির্দেশ কেন কমিশন মানছে না, তা নিয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ৷ মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে কমিশন আদালতের নির্দেশ মানতে ব্যর্থ বলেও উল্লেখ করেন ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি ৷
শুনানিতে বিরোধী দলনেতার আইনজীবী সৌম্য মজুমদার জানান, সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ পুলিশ । বিভিন্ন জায়গায় লোক আক্রান্ত । টিভিতে তা দেখানো হচ্ছে । কোন কোন জেলা স্পর্শকাতর, তা স্পষ্ট করা হোক । এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিধানসভা নির্বাচনের হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছিল গোটা রাজ্যের সব জেলাতেই রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল । পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাধারণ গ্রামীণ জনতা আক্রান্ত । পৌর এলাকার সঙ্গে তা তুলনা করা যথাযথ নয় ।
আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হচ্ছে না বিরোধীদের । ভয় পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এখনও পর্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা চিহ্নিত করতে পারেনি কমিশন । সিঙ্গল বেঞ্চে এই নিয়ে মামলাও দায়ের হয়েছে ।
তারপরই প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, "রাজ্য নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত আদালতের নির্দেশ মানতে ব্যর্থ, প্রাথমিক ভাবে সেটাই দেখা যাচ্ছে । আমরা প্রার্থীদের নিয়ে চিন্তিত নই । আমরা সাধারণ ভোটারদের নিয়ে চিন্তিত । আপনাদের হয়তো মনে হচ্ছে কিছু হচ্ছে না । আমরা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকব না ।"
রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগের সুরে বলেন, "ভাঙড়ে আইএসএফ নামে একটা রাজনৈতিক দল 15 হাজার সমর্থক নিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে । তারাই আবার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে নিরাপত্তার আবেদন জানাচ্ছে ।"
আদালতের দ্বিতীয়ার্ধে বাম শিবিরের আইনজীবী আবেদন জানান চোপড়া, উত্তর দিনাজপুর, ভাঙড়ে গুলি চলেছে । কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা দেওয়া হোক গোটা রাজ্যে । এর পর রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে কিছু রিপোর্ট দেওয়া হয় । সেখানে দেখা যায় 9 জুন রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও মুখ্য সচিব একটা বৈঠক করেছিলেন নিরাপত্তা ইস্যুতে । সেখানে স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয় ।
এটা দেখে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, তারপর কিছু করা হয়নি ? নির্বাচন কমিশনের তরফে আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র বলেন, "এখনও স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করা হয়নি । ফলে কত পরিমাণ বাহিনী লাগবে, সেই আবেদনও কেন্দ্রকে জানানো হয়নি ।"
রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় গলা চড়ান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধা নেওয়ার জন্য বারবার আদালতে অভিযোগ করছে বলে । তিনি বলেন, ‘‘আদালত বিচার করতে পারে মামলাকারীরা কী দাবি জানাচ্ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে, তার বাইরে নয় ।’’ অর্থাৎ আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি । সংবাদমাধ্যমে কী দেখা গিয়েছে তাই দিয়ে বিচার হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন তিনি ।
তিনি পালটা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আদালতে এসে বলা হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্যরা মার খাচ্ছে । কারা ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য । কোথায় অভিযোগ জানিয়েছে তারা ? মিডিয়াতে কী দেখানো হচ্ছে, তাতে আস্থা রাখবেন নাকি আইনে ? যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা বানানো নয় তো ? মিডিয়া রিপোর্ট আইনের কাছে গ্রহণযোগ্য ? এখানে কি জনস্বার্থ নাকি রাজনৈতিক দলের স্বার্থ নিয়ে বিচার হচ্ছে !’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘2003 সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে 70 জনের বেশি মারা গিয়েছিল । বিধানসভা বয়কট করা হয়েছিল । এখন তারা এখানে সাধু সাজতে এসেছে ! তারা সন্ত্রাসের অভিযোগ করতে এসেছে । সন্ত্রাসের নামে কোনও রাজনৈতিক দলকে বিশেষ সুবিধা করে দিতে পারে আদালত ? দু-এক জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া, এখন পর্যন্ত মনোনয়ন জমা হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবেই ৷ অভিযোগ পেলেই পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করেছে । পাশাপাশি ভোটের জন্য ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু থেকে পুলিশ চেয়েছে রাজ্য । কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেই শুধুমাত্র রাজ্যের মানুষ আত্মবিশ্বাস পাবে ?’’
যদিও বিজেপির তরফে এর পালটা উল্লেখ করা হয়, গত বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল । জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছিল গোটা রাজ্যই স্পর্শকাতর । সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ 48 ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে গোটা রাজ্যে ।
আরও পড়ুন: মনোনয়নের শেষদিনে রক্তাক্ত ভাঙড় থেকে চোপড়ায় নিহত 4, দায় এড়ালেন মমতা