কলকাতা, 19 সেপ্টেম্বর : 2014 সাল । সে বছর 2 অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে একটি বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় । বিস্ফোরণের ঠিক আগে শাকিল আহমেদ, সুবহান সেখ এবং আবদুল হাকিম হাসান চৌধুরির দোতলায় বসে IED তৈরি করছিল । হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণ । শাকিল এবং সুবহান ঘটনাস্থানেই মারা যায় । ওই বাড়িতে ছিল দুজন মহিলা হালিমা বিবি ও রাজিয়া বিবি । তাদের সঙ্গেই ছিল দুই শিশু । সেই ঘটনায় রীতিমতো হইচই পড়ে যায় । ঘটনার পর গা ঢাকা দেয় সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন । জামাতুল মুজাহিদিন আমের সালাউদ্দিন এখনও পর্যন্ত অধরা । অনেকের সন্দেহ সে লুকিয়ে রয়েছে কাশ্মীরে । লক্ষ্যণীয়ভাবে সে বছরই আল কায়দা প্রধান আল জাওয়াহিরি ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়দার উপস্থিতির কথা ঘোষণা করেন । পরের বছর অর্থাৎ 2015 সালে জাওয়াহিরি ঘোষণা করেন আল কায়দার উপমহাদেশ শাখার নতুন সংগঠনের নাম । সে বছরই তৈরি হয় কায়দাতুল জিহাদ ।
2005 সাল । 17 অগাস্ট । ধারাবাহিক বিস্ফোরণে উঠে আসে সালাউদ্দিন ওরফে সালোহীনের নাম । পরে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে । দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় তিনটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ আদালত । 2014 সালের 23 ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে তাকে এবং কওশরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অন্য জেলে । সেই প্রিজনভ্যানে পুরোপুরি সিনেমার কায়দায় ঘিরে ধরে করা হয় আক্রমণ । জঙ্গিদের গুলিতে মৃত্যু হয় এক পুলিশকর্মীর । সালাউদ্দিন, কওসর এবং রাকিবুল হাসানকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জামাত জঙ্গিরা । পরে অবশ্য বাংলাদেশের মির্জাপুরে পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় রাকিবুল হাসানের । কিন্তু সালাউদ্দিন এবং কওসর পালিয়ে আসে ভারতে । তারপরই পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি কার্যকলাপের ইতিহাস বইতে শুরু করে অন্য খাতে ।
মুর্শিদাবাদে জামাত যোগের কথা প্রথম সামনে আসে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর । জানা যায়, মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্যরা প্রথমবার ভারতে ঢোকে । হলি আর্টিজন মামলায় বাংলাদেশের ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত হাত কাটা নাসিরুল্লাহ ঢুকেছিল লালগোলা সীমান্ত দিয়ে । তারপর সীমান্ত লাগোয়া মোকিমনগরে তৈরি করে ঘাঁটি । একটু একটু করে দখল করে নেয় মোকিমনগর মাদ্রাসা । সেখান থেকেই শুরু করে মগজধোলাইয়ের কাজ । আবার বেলডাঙার বোরখা ঘর নামে পোশাকের দোকানের আড়ালে বোমা সরবরাহের ডেরাও তৈরি করা হয়েছিল । তার আড়ালে ছিল শাকিল গাজি । সেখানে যাতায়াত ছিল হাত কাটা নাসিরুল্লাহের ।
খাগড়াগড় কাণ্ড নিয়ে NIA র তদন্তে উঠে এসেছিল মুর্শিদাবাদের উমরপুরে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের সাইবার সেল তৈরির পরিকল্পনা করেছিল নাসিরুল্লাহ । তার জন্য অসম সরকারের তরফে ছাত্রদের দেওয়া লাপটপ জোগাড় করেছিল সে । জোগাড় করেছিল বেশ কয়েক জন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকেও । খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরেই ফের সামনে আসে সালাউদ্দিন এবং কওসরের নাম । জানা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে ঢুকেই মাত্র আট মাসের মধ্যে মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম, নদিয়া, বর্ধমানে জঙ্গি জাল বিস্তার করে ফেলেছে সালাউদ্দিন ।
পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা থেকে গ্রেপ্তার 9 আলকায়দা জঙ্গি
তখনও পর্যন্ত সে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের আমের(শীর্ষ নেতা) । খাগড়াগড় বিস্ফোরণে প্রচুর ধরপাকর হলেও সালাউদ্দিন, বোমারু মিজানদের টিকিটিও ছুঁতে পারেননি গোয়েন্দারা । এর মাঝে ওই জঙ্গি সংগঠনের হয়ে যায় আড়াআড়ি বিভাজন । রাগচটা স্বভাবের কওসর এবং হাতকাটা নাসিরুল্লাহ অন্তর্দ্বন্দ্ব এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিল । পরে মতাদর্শের পার্থক্য দেখা যায় । হাত কাটা নাসিরুল্লাহ বিশ্বাস করত ধীরেসুস্থে নয়, জিহাদ করতে হবে দুরন্ত গতিতে ।
সালাউদ্দিনের বিশ্বাস আবার ছিল অন্য । নাসিরুল্লাহ সঙ্গে বাংলাদেশের আরও কিছু জঙ্গি নেতার মিলে যায় । সে দেশে তৈরি হয়ে যায় নব্য জামাত বা নিও JMB । তারা ISIS-র মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে । শোনা যায়, আল-কায়দার হয়ে আফগান যুদ্ধ লড়ে আসা সালাউদ্দিন আঁকড়ে ধরেছিল লাদেনের পথ । আর সেই পথেই আল-কায়দার উপমহাদেশের সংগঠন কায়দাতুল জিহাদের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসে জামাতুল মুজাহিদিনকে । আজ জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে মুর্শিদাবাদের গ্রেপ্তার হওয়া নাজমুস সাকিব, আবু সুফিয়ান, মইনুল মন্ডল, লিউইয়ান আহমেদ, আল মামুন কামাল, আতিউর রহমান আদতে জামাত জঙ্গি হিসেবেই প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে ।
গোয়েন্দাদের ধারণা, তারা সালাউদ্দিনের হাত ধরেই কায়দাতুল জিহাদের খাতায় নাম লিখিয়েছে । গোয়েন্দাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, জিহাদ সংক্রান্ত বইপত্র ছাড়াও উদ্ধার হয়েছে অডিয়ো টেপ । সংগঠনে নিয়ে আসার জন্য টার্গেট থাকা মুসলিম যুবকদের দাওয়াত দেওয়ার পর, এই অডিয়ো টেপ শুনিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করা হত বলে জানা যাচ্ছে । ইতিমধ্যেই ইটিভি ভারতের হাতে এসেছে অডিয়ো টেপ ।
"কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল ওরা"
সেখানে শোনা যাচ্ছে, "আমি সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়কে সাধারণভাবে জামাত কায়দাতুল জিহাদের একটি নতুন শাখা জামাত কায়দাতুল জিহাদ উপমহাদেশ প্রতিষ্ঠার মোবারকবাদ জানাচ্ছি । এবং পাকিস্তান, ইন্ডিয়া সহ পুরো উপমহাদেশের মুসলমানদের বিশেষভাবে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি । " নিখাদ বাংলা উচ্চারণে সেই অডিয়ো টেপ । যেখানে আরও শোনা যাচ্ছে, “ প্রাণপ্রিয় আমির শাইখ আইমান আল-জাওয়াহিরি হাফিজুল্লাহের দেওয়া নির্দেশনাকে জামাতের সমস্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার প্রত্যয় মাওলানা আসেম উমর হাফিজুল্লাহের নেতৃত্বে একত্রিত হওয়ার মোবারক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ... এর উদ্দেশ্য আমেরিকা এবং তার সহযোগীদের দাসত্বে আবদ্ধ সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত কুফরি শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করা । এই শাসনতন্ত্রকে শিকড় সহ চিরতরে উৎখাত করার চেষ্টা করা । আর এই কুফরি শাসনব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে কালিমায়ে তাওহীদের সমুন্নত করা । কেন না এটাই সেই অভিশপ্ত শাসন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে খিলাফতে উসমানিয়াকে ভেঙে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে । "
"বাংলা বেআইনি বোমা তৈরির আড়ত", জঙ্গি গ্রেপ্তারির প্রসঙ্গে সরব ধনকড়
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জামাত কায়দাতুল জিহাদ তৈরির উদ্দেশ্য হল, আল-কায়দাপন্থী সবকটি জঙ্গি সংগঠনকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা । তারপর দৃঢ়ভাবে জিহাদ করা । সেই জিহাদের অঙ্গ হিসেবে জেলবন্দী জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছক রয়েছে । নিজেদের সংগঠনের অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার জন্য তারা বিস্ফোরণের ছক করছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে NIA ।
(এই অডিয়ো টেপের সত্যতা যাচাই করেনি ইটিভি ভারত । )