কলকাতা, 5 জুন : একুশের লড়াইটা মোটেই সহজ ছিল না তৃণমূলের জন্য । গদি ধরে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ বলে মনে হচ্ছিল একটা সময় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু'শো পার । লড়াইয়ের মুখ অবশ্যই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কিন্তু নেপথ্যে থেকে যিনি নাগাড়ে জান কবুল লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, তিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় । কম বক্রোক্তি শুনতে হয়নি । কথায় কথায় আক্রমণ । তোলাবাজ ভাইপো । কিন্তু তবু লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন । আর আজ তার পুরস্কার পেলেন । গুরুত্ব বাড়ল তৃণমূলে । এখন তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক । মুকুল রায়ের ছেড়ে যাওয়া পদে এবার অভিষেক ।
মমতা যতই বলুন তিনি অভিষেককে কোনওদিন আলাদা চোখে দেখেননি, কিন্তু বিরোধীদের মাঝেমধ্যেই বলতে শোনা যায়, অভিষেকের নাকি নিজস্ব কোনও ক্যারিশ্মা নেই । পিসির ক্যারিশ্মার উপর ভর করেই নাকি তাঁর রাজনৈতিক উত্থান । কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা বিচার করা কঠিন । তবে বিগত কিছুদিনে অভিষেককে ভীষণভাবে সক্রিয় দেখিয়েছে রাজনীতির আঙিনায় ।
মুখে কিছু না বললেও অনেক তৃণমূল নেতাই জানেন, অভিষেক না থাকলে হয়ত একুশের ভোটের লড়াইটা আরও কঠিন হত মমতার জন্য । দৌড়ে বেরিয়েছেন বাংলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত । একের পর এক সভা । শুভেন্দুর খাসতালুকে দাঁড়িয়ে "বাপকে গিয়ে বল..." এমন অনেক কিছু রয়েছে যা ভোটের আগে তৃণমূলের নিচুতলায় সাহস জুগিয়েছিল । ভরসা জুগিয়েছিল ।
ভোটের পরেও সমান সক্রিয়তা । যশ বিপর্যস্ত উপকূলবর্তী এলাকা পরিদর্শনে অভিষেক । ত্রাণ বিলির তদারকিতে অভিষেক । মুকুল-জায়াকে দেখতে হাসপাতালে অভিষেক । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তিনিই যেন হয়ে উঠেছিলেন দলের অঘোষিত সেকেন্ড-ইন-কমান্ড । এবার আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক । এবার আর সরাসরি সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বলতে কোনও বাধা থাকল না ।
আরও পড়ুন, TMC Meeting : তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক, যুব তৃণমূলের সভানেত্রী সায়নী
আজ দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শেষে কাকলি ঘোষ দস্তিদারকেও দেখা গেল অভিষেককে নিয়ে বেশ গদগদভাব । বললেন, " অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে বিগত কয়েকবছর ধরে কাজ করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় । রাজনৈতিক পরিপক্কতা আছে । অভিজ্ঞতা আছে । রাজনীতিটা বোঝে । ও আরও এগিয়ে যাক সেই আশীর্বাদ করি ।"
তবে দলে অভিষেকের গুরুত্ব বাড়ানোটা শুধুই কি সাংগঠনিক রদবদল ? নাকি এর পিছনে রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও দূরদর্শিতা ?
বলে রাখা প্রয়োজন, একুশের ভোটের আগে যে নেতা-নেত্রীরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশের ক্ষোভ ছিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে । শুভেন্দু অধিকারী বা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়রা তো প্রকাশ্যেই একাধিকবার মুখ খুলেছেন 'ভাইপো'-র বিরুদ্ধে । না জানি দলের আরও কোন কোন নেতা এমনটা ভাবেন ! তাই কি অভিষেকের বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতেই মমতার এই সুকৌশলী চাল ?
যদি তাই হয়, তাহলে এই চাল ফল দেখাতে পারে 2024-এর লোকসভা ভোটে । দিল্লির রাজনীতিতে ক্রমেই নিজের প্রাসঙ্গিকতা বাড়াচ্ছেন মমতা । ভারতে এখন যে ক'টি আঞ্চলিক দল রয়েছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে একেবারে সামনের সারিতে বসে রয়েছে তৃণমূল । তবে সমস্যা এক জায়গাতেই । দলের মুখ বলতে শুধুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । বাকিরা যেন অনেকটাই ফিকে সর্বভারতীয় স্তরে । সেদিক থেকে দেখতে গেলে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দিল্লির রাজনীতিতে অবশ্যই মমতার সঙ্গে সমান তালে প্রাসঙ্গিকতা বাড়বে অভিষেকের ।
আরও পড়ুন, Prabir Ghoshal : প্রবীর ঘোষাল কি আবারও তৃণমূলে ? জল্পনা তুঙ্গে
দলের উত্তরাধিকার বা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব সঁপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে যে সবসময় সঠিক হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই । গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস সভাপতির মতো গুরুদায়িত্বের বোঝা পুত্র রাহুল গান্ধির কাঁধে সঁপেছিলেন সোনিয়া গান্ধি । লোকসভার ফল কী হয়েছিল তা সকলেরই জানা । দলকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত সেই সোনিয়াকে ফের দায়িত্ব তুলে নিতে হয় । অসুস্থ শরীরে এখনও তিনি কংগ্রেসের শেষ কথা । আবার সঠিক সময়ে পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে আসার ফল পাচ্ছে মুলায়ম সিং যাদবের দল । অখিলেশ আজ দিল্লির রাজনীতি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক । বিহারে লালু-পুত্র তেজস্বী যাদব ভোট বাক্সে প্রতিফলন দেখাতে পারেননি ঠিকই, তবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন রাজনীতির আঙিনায় ।
হতেই পারে আগের উদাহরণগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক চাল খেলতে চাইছিলেন মমতা । আজ অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করাটা হয়ত তাঁকে দিল্লির রাজনীতিতে এগিয়ে দেওয়ার সেই সূচনা । ভোটের আগে প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন অভিষেক । দিল্লির রাজনীতির তালিম মমতার পর যদি অভিষেক কারও থেকে সবথেকে ভাল পেয়ে থাকেন তিনি প্রশান্ত কিশোর । আজ কাকলি ঘোষ দস্তিদার ঠিকই বলেছেন । অভিষেক এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক পরিপক্ক । অভিজ্ঞও । মমতা নিজেও তা বিলক্ষণ বোঝেন । আর সম্ভবত সেই কারণেই প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন অভিষেককে দিল্লির রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ।