কলকাতা, 26 অগাস্ট : মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করতে চেয়েছিলেন স্বামী-স্ত্রী । কিন্তু, তাঁদের এই যৌথ ইচ্ছা পূরণের আগেই ঘটে গেল বিপত্তি । স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন স্ত্রী । তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হল না । ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয় । এই পরিস্থিতিতে, লিভার এবং কর্নিয়া দানের মধ্যে দিয়েই স্ত্রীর ইচ্ছাকে সম্মান জানালেন স্বামী । কিছুটা হলেও স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করলেন ।
প্রশান্ত দে । বয়স 67 । রাজ্য সরকারের এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন । তাঁর স্ত্রী শেলী দে । বয়স 61 । গৃহবধূ । বাঁশদ্রোণীর ঊষা পার্কের কাছে অবস্থিত এক ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা প্রশান্ত-শেলী চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁদের বিভিন্ন অঙ্গ যেন অন্য মানুষের উপকারে আসে, তাঁদের দেহ যেন মেডিকেল সায়েন্সের কাজে লাগে । কিন্তু, যৌথ ইচ্ছা সম্পূর্ণ পূরণ হল না । কারণ, গত শুক্রবার সকালে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন শেলী । তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মুকুন্দপুরের বেসরকারি একটি হাসপাতালে । সেখানে বেড না থাকায় নিয়ে যাওয়া হয় অন্য আর একটি বেসরকারি হাসপাতালে । মুকুন্দপুরের বেসরকারি এই হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে রাখা হয় শেলীকে । কিন্তু, শেষ রক্ষা হল না । দ্বিতীয় দফায় অ্যাপনিয়া টেস্টের পরে গত শনিবার রাত 9টা নাগাদ তাঁর ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয় । গতকাল রাতে তাঁর লিভার ব্যারাকপুরের বাসিন্দা 62 বছর বয়সি এক পুরুষ রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয় (তিনিও মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি) । শেষ হয় আজ সকাল 8টা নাগাদ । শেলীর কর্নিয়া দান করা হয়েছে বেসরকারি একটি আই ব্যাঙ্কে ।
প্রশান্তবাবু বলেন, "অঙ্গদানের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা করতেন স্ত্রী । উনি অসুস্থ ছিলেন । মাঝে মধ্যেই বলতেন, যদি কোনও কিছু হয়ে যায়, তা হলে যেন অঙ্গদান করি ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "মৃত্যুর পরে আমাদের অঙ্গ যদি অন্য মানুষের উপকারে আসে, আমাদের দেহ যদি মেডিকেল সায়েন্সের কাজে লাগে, তার জন্য আমরা মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করতে চেয়েছিলাম । যাদবপুরের একটি কেন্দ্রে ফোন করে সব জেনে নিয়েছিলাম । যে কোনও দিন ওখানে গিয়ে আমরা মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করতাম । কিন্তু, এর কয়েক দিনের মধ্যে, স্ত্রীর শরীর আরও খারাপ হয়ে গেল । ভাবতেই পারিনি এরকম হবে ।" তিনি বলেন, "ডাক্তাররা যখন বললেন আমার স্ত্রীকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়, ওঁর ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে, তখন অঙ্গদানের জন্য স্ত্রীর ইচ্ছার কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাই ।"
শেলী দে-র শুধুমাত্র লিভার এবং কর্নিয়া দান করা সম্ভব হয়েছে । এই বিষয়ে প্রশান্তবাবু বলেন, "আমার এবং স্ত্রীর যেহেতু মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করার ইচ্ছা ছিল, সেই জন্য একটু আশাহত হয়েছি । যে অঙ্গগুলি অন্য মানুষের কাজে লাগবে, তার সঙ্গে বডিটাও আমরা দিতে চেয়েছিলাম । আমাদের ইচ্ছা খানিকটা পূরণ হল ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "আমার স্ত্রী চেয়েছিলেন, তাঁর যে অঙ্গগুলি সঠিক অবস্থায় রয়েছে, সেগুলি যেন অন্য দেহে যায় । এটা আমরা কিছুটা করতে পেরেছি, এর জন্য আমরা আনন্দিত ।" প্রশান্তবাবুর আক্ষেপ, "আমাদের দেশে এখনও হয়তো পরিকাঠামো সেই ভাবে গড়ে ওঠেনি । সেই জন্য একটা দিন, পুরো ২৪ ঘণ্টা এই লিভার এবং কর্নিয়া দানের জন্য লেগে গেল ।" একই সঙ্গে তাঁর প্রত্যাশা, "আশা করি, আমরা যদি এভাবে এগোই, তা হলে এক সময় হয়তো পরিকাঠামো আরও উন্নত হবে । যে কোনও সরকারি হাসপাতালে হাজার হাজার রোগী ভরতি রয়েছেন । তাঁদের অনেকের অনেক কিছু দরকার । যদি পরিকাঠামো গড়ে ওঠে এবং আমাদের মতো মানুষ যদি অঙ্গদানের জন্য আরও এগিয়ে আসেন, তা হলে মানুষের উপকার হবে ।"
প্রশান্তবাবু বলেন, "স্ত্রীর সব কাজকর্ম (শেষকৃত্য) মিটে গেলে, আমি মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করব ।"
গত শুক্রবার শেলী স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেও, দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছিলেন । তিনি বলেন, "ওর অ্যাজমা ছিল । ব্লাড সুগারও ছিল, তবে সামান্য । নিয়মিত ওষুধ খেতেন । 10-12 বছর ধরে এ সব সমস্যা থাকলেও, বাড়িতে সব কাজকর্ম করতেন স্ত্রী । আমাদের একমাত্র মেয়ে ঝিলিক কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা । তাঁকেও যতটা সম্ভব সাহায্য করতেন । কোনও সময় শয্যাশায়ী ছিলেন না, একদিনের জন্যেও নয় ।" আরও বলেন, "গত শুক্রবার সকালে যখন আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তার আগেও হেঁটে-চলে বেরিয়েছেন ।" কী হয়েছিল? প্রশান্ত দে বলেন, "বমি হয়েছিল, কয়েক মিনিটের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন । আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না । মেয়ে সব দেখাশোনা করছিল । ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরাও চলে এসেছিলেন । আমিও চলে আসি । তবে, আমরা বুঝতে পারিনি কী ঘটেছে । যখন যা বলেছেন, তখন তাই ওষুধ দিয়েছি । কখনও বলেছেন ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে, তখন তার জন্য ওষুধ দিয়েছি । কিন্তু, আমরা তো বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটে গেছে । এর মধ্যেও কথাবার্তা বলছিলেন, খাইয়ে দিলে খাচ্ছিলেন, বাথরুমে যাচ্ছিলেন ।" তিনি বলেন, "স্থানীয় দোকান থেকে ব্লাড প্রেসার চেক করা হল । দেখা গেল, ব্লাড প্রেসার হাই রয়েছে । অথচ, বছরে 7-8 বার ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে যেতে হত । প্রতিবারই ব্লাড প্রেসার মাপা হত । কিন্তু, কখনও ওর হাই ব্লাড প্রেসার ধরা পড়েনি ।" এদিকে, আচমকা এভাবে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ডাক্তারের খোঁজ করছিলেন তাঁরা । প্রশান্তবাবু বলেন, "ওই দিন জন্মাষ্টমী ছিল । আমরা ডাক্তার পাচ্ছিলাম না । অনেক ডাক্তারকে বাড়িতে আসার জন্য বলা হয়েছিল । কেউ বললেন সল্টলেকে আছি, কেউ বলছেন কলকাতার বাইরে ।"
মাঝে মধ্যে বমি করতেন শেলী । এই জন্য ওই দিন তাঁর বমি করাটা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা । এর জন্য বমি না হওয়ার ওষুধও খাইয়েছিলেন । একথা জানিয়ে প্রশান্ত দে বলেন, "হোমিওপ্যাথির ডাক্তার এসেছিলেন । আমরা ডেকেছিলাম অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার । কিছু করার নেই । তিনি দেখে কিছু ওষুধ দিলেন । সেগুলো খাওয়ানো হল । কিন্তু ওষুধে কাজ করল না । এরপর আচমকা একটা খিঁচুনি । আমরা আর কোনও ঝুঁকি নিইনি ।" অ্যাম্বুলেন্সে করে শেলীকে নিয়ে যাওয়া হয় মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে । তাঁদের মনে হয়েছিল হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত কোনও সমস্যা হয়ে থাকতে পারে । এই জন্য শেলীকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । একথা জানিয়ে প্রশান্ত দে বলেন, "এই হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কোনও বেড ফাঁকা নেই, এমন কী ট্রলিও ফুল হয়ে রয়েছে । সেখানে ভরতি নিত চাইল না হাসপাতাল ।" এরপর ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য আর একটি বেসরকারি হাসপাতালে । শেলীকে রাখা হয় ভেন্টিলেশনে ।
প্রশান্তবাবু বলেন, "স্ত্রীকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হচ্ছে, এই বিষয়ে হাসপাতাল মতামত জানতে চাইলে বলি, শুধু ভেন্টিলেশন নয়, রোগীকে ভালো করে তোলার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার জন্য আমরা সব রকম স্বাধীনতা দিচ্ছি ।" তিনি বলেন, "সিটি স্ক্যান করার পরে আমাদের দেখানো হল, মস্তিষ্কে যেভাবে রক্ত ছড়িয়ে গেছে, তাতে কিছু করতে পারবেন না ডাক্তাররা । তবে, তাঁরা জানালেন, যতক্ষণ পারছেন চেষ্টা করছেন । ভেন্টিলেশনের সহায়তা দিয়ে ICU-তে রাখা হয় স্ত্রীকে । ওই দিন রাতে এবং পরের দিন সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরে ডাক্তাররা আমাদের বলেন, তাঁরা দুঃখিত, তাঁরা কিছু করতে পারছেন না । করার মতো আর কিছু নেই ।"
প্রশান্তবাবু বলেন, "হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আমরা বললাম, আমার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, শরীরের অঙ্গ, যেগুলি কাজে লাগানো সম্ভব, সেগুলি দানের জন্য আমাদের মত রয়েছে । এর পরে প্রক্রিয়া শুরু করা হল ।" তিনি বলেন, "যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন আমার স্ত্রী, সেই জন্য ওর হৃদযন্ত্র নেওয়া সম্ভব হয়নি । ব্লাড সুগারের জন্য কিডনি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । এর জন্য কিডনিও নেওয়া হয়নি ।" গতকাল রাতে তিনি বলেন, "লিভার, কর্নিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে । এই কর্নিয়ায় দু'জনের চক্ষুদান যাতে হয়, সে রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে । কিন্তু, স্ত্রীর দেহ কাউকে দিতে পারলাম না । এই জন্য নিমতলা ঘাটে আমরা সৎকার করব ।"