ETV Bharat / state

দেশে আছে, ম্যাপে নেই ! - ছিটমহল বিনিময় চুক্তি

দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ এই গ্রামের জমিগুলি অ্যাডভার্স পোজ়েশনের মধ্যে ছিল ৷ ফলে ভারতে থেকেও ম্যাপে অন্তভুক্ত হয়নি এই এলাকাগুলি ৷ 2015 ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির পর উল্লেখিত গ্রামগুলির জমি জরিপের কাজ শুরু হয়েছে ৷ বেরুবাড়ি সংলগ্ন ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যে চলছে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ ৷ প্রশাসনিক সূত্রে খবর, সীমানা নির্ধারিত হলেই ম্যাপে জায়গা করে নেবে এই এলাকার জমিগুলি ৷

jalpaiguri
জলপাইগুড়ি
author img

By

Published : Feb 28, 2020, 9:50 PM IST

Updated : Mar 7, 2020, 4:29 PM IST

জলপাইগুড়ি, 27 ফেব্রুয়ারি : "সরকারি সুযোগ সুবিধার মুখ সবে দেখতে শুরু করেছি ৷ ইদানিং রাস্তা-ঘাট হচ্ছে ৷ সবাই জানে আমরা ভারতের নাগরিক ৷ অথচ এদেশের ম্যাপে আজও আমাদের গ্রামের জমিগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়নি ৷"

"ওই জমিটা দেখতে পাচ্ছেন ? ওটা আমার ৷ ওখানেই আমি ফসল ফলাই ৷ সারাবছর খাটি ৷ কিন্তু, ওই জমি বিক্রির অধিকার আমার নেই ৷ বাড়িতে সুবিধে-অসুবিধে রয়েছে ৷ বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে বইকি মাঝে মাঝে ৷ কিন্তু, পারি না ৷ দেশে থেকেও সব সুযোগ সুবিধে পাচ্ছি না ৷"

Berubari
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুনের বেরুবাড়ি নিয়ে চুক্তি

জলপাইগুড়ি সদর ব্লক লাগোয়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেরুবাড়ি এলাকা ৷ প্রথম বক্তা দেবব্রত রায় প্রধান ৷ দ্বিতীয়জন সত্যেন রায় প্রধান ৷ দু'জনেই জানালেন এই সমস্যা শুধু তাঁদের নয় ৷ কয়েক দশক ধরে একই সমস্যায় ভুগছে দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের তরফে জানা গেছে, এই গ্রামগুলি আসলে অ্যাডভার্স পোজ়েশনের মধ্যে ছিল ৷ এখনও জমি জরিপের কাজ চলছে ৷ ফলে জমিগুলির মালিকরা হাতে কাগজপত্র পাননি ৷ জরিপ ও দুই দেশের মাঝে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শেষ হওয়ার পরই গ্রামের জমিগুলিকে ভারতের ম্যাপে আনা হবে ৷ তখন জমি বিক্রির অধিকারও পাবেন মালিকরা ৷ একই তথ্য দিলেন জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায় ৷ জানালেন, জমি জরিপ ও দুই দেশের মাঝে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শেষ না হলে অ্যাডভার্স পোজ়েশনের তকমা মুছবে না এই এলাকাগুলির ৷

Berubari
পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার দাবিতে বেরুবাড়ির আন্দোলন

কেন এই সমস্যা ? এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস ৷ 1947 সালে দেশ ভাগের পর বেরুবাড়ি কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নিয়ে সমস্যা দানা বাঁধে ৷ 1958 সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ চুক্তিতে ঠিক হয়, দক্ষিণ বেরুবাড়ির অর্ধেক অংশ পাকিস্তানকে দেওয়া হবে ৷ ফলে দক্ষিণ বেরুবাড়ির একটি নির্দিষ্ট অংশ তৎকালীন পাকিস্তানে চলে যায় । কিন্তু, নিজেদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ ভারতেই থাকার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তারা ৷ 1961 সালের 26 জানুয়ারি বেরুবাড়ির বাসিন্দারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রাণ থাকতে পাকিস্তানে যাবে না ৷ "রক্ত দেব প্রাণ দেব, বেরুবাড়ি ছাড়ব না", এই শ্লোগানকে হাতিয়ার করে চলতে থাকে আন্দোলন ৷ 1971 সালে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে বাংলাদেশ নামে এক আলাদা রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে ৷ প্রধানমন্ত্রী হন শেখ মুজিবর রহমান ৷ এবারে পরিস্থিতি ফের বদলায় ৷ 1974 সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে তিনবিঘা করিডোর চুক্তি হয় ৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ বেরুবাড়ির যে অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তা ভারতকে হস্তান্তর করা হবে ৷ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে দক্ষিণ বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ বেরুবাড়ি আন্দোলনের ফলেই ভারতে থাকার অধিকার পেল বলে মনে করতে থাকে তারা ৷

ম্যাপে নেই বেরুবাড়ি এলাকার বেশ কয়েকটি জায়গা

তবে এবার এক নতুন সমস্যা দেখা দেয় ৷ 1974-এর চুক্তি বেরুবাড়ির নির্দিষ্ট অংশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও জমি জরিপ ও সীমানা নির্ধারণের সময় সমস্যা তৈরি হয় ৷ দেখা যায়, ওই এলাকায় ভারতের এমন কিছু জমি আছে যেখানে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করছে আবার বাংলাদেশের কিছু জমিতে ভারতের লোকও বসে রয়েছে ৷ সেই জায়গাগুলিকে অ্যাডভার্স পোজ়েশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ এরকমই জায়গা হল এই চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ ফলে ওই এলাকার জমির জরিপ ও সীমান্ত নির্ধারণ না হওয়ায় ভারতের মানচিত্রে এলাকাগুলিকে জায়গা দেওয়া হয়নি ৷ ফলে ভারতে থাকার আন্দোলন শেষ হতে না হতেই আবারও সমস্যায় পড়ে বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ অ্যাডভার্স পোজ়েশন মধ্যে থাকায় বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে তারা ৷ প্রশাসনের তরফে বেরুবাড়ির মানুষকে আশ্বাস দেওয়া হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এই সমস্যার সমাধান হবে ৷

Berubari
2015-র ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিতে বেরুবাড়ির উল্লেখ

2015 সাল ৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ নির্ধারিত সীমায় কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শুরু হয় ৷ বেরুবাড়ির অ্যাডভার্স পোজ়েশনে কাজ শুরু করে প্রশাসন ৷ জমি জরিপ ও কাঁটাতার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় ৷ তবে ওই এলাকার মানুষের অভিযোগ, উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজ চলছে ধীর গতিতে ৷ কবে শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না ৷

Berubari
1974 সালে ইন্দিরা গান্ধি ও শেখ মুজিবর রহমানের চুক্তিপত্র

এই বেরুবাড়ির বাসিন্দা সত্যেন রায় প্রধান ৷ এখন বয়স হয়েছে ৷ বেরুবাড়ি সমস্যার প্রথম থেকেই সাক্ষী ৷ সেই তিনি জানালেন, "এখান থেকে বাংলাদেশ দেখতে পাই ৷ ওই যে জমি জরিপের কাজ শুরু হয়েছে ৷ এখনও চলছে ৷ দেখি কতদিনে কী হয় ৷"

দীপচরণ রায় যেমন বললেন, "এখানে স্কুল আছে ৷ রাস্তা আছি ৷ যত দ্রুত ভারতের মানচিত্রে আমাদের গ্রামগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে ভালো ৷ সেটা না হওয়া পর্যন্ত ঠিক ভরসা করতে পাচ্ছি না ৷ অনেকদিন ধরেই তো আমরা কষ্ট পাচ্ছি ৷ আমাদের জমির খতিয়ান নেই ৷ থেকেও যেন নেই ৷ বিক্রি বা কিনতে পারি না ৷ সরকার দেখুক ৷"

berubari
জমি থাকলেও তা বিক্রির অধিকার নেই

কাজ শুরু হলেও দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে না বলে অভিযোগ করলেন জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায় । তাঁর কথায়, "একসময় দক্ষিণ বেরুবাড়ির কিছু অংশ বাংলাদেশে ছিল । সেগুলো পরে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় । তবে সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে দুই দেশের সরকারই সমস্যায় পড়ে ৷ কিছু জায়গাকে অ্যাডভার্স পোজ়েশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ 2015-র ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পর জমি জরিপের কাজ নতুন করে শুরু হয় । এখন দুই দেশের মাঝে দেওয়া হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়াও । দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে কিন্তু, এখনও কাজ শেষ হয়নি । ফলে দেশে থেকেও মানচিত্রে নেই ওই এলাকার জমিগুলি । প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে । ''

কবে হবে জমি জরিপের কাজ শেষ ? কবে দেশের মানচিত্রে জায়গা পাবে বেরুবাড়ির সেই বিতর্কিত এলাকাগুলি ? জানতে জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের BDO তাপসী সাহার কাছে গেছিলেন ETV ভারতের প্রতিনিধি ৷ তাপসীদেবী বলেন, "ওই এলাকায় জমির সার্ভের কাজ শেষ হয়নি ৷ কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকায় ওখানকার মানুষ সমস্যায় পড়ছেন ৷ আমি বিষয়টি জানি ৷ ওই এলাকাগুলিতে এখন পাকা রাস্তা হয়েছে ৷ সরকারি সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে ৷ তবে মানচিত্রের বিষয়টি আমি বলতে পারব না ৷"

মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক অভিষেক তিওয়ারির কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "বিষয়টি নিয়ে আমি খোঁজখবর নেব ৷"

বেরুবাড়ির বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, মানচিত্রে জায়গা পায়নি একাধিক গ্রাম ৷ সেই তথ্য সবার জানা ৷ প্রশাসনের আধিকারিকরাও জানেন ৷ কিন্তু, এটা আন্তর্জাতিক ইশু, তাই প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না ৷

তবে তাদের গ্রাম মানচিত্রে যতটা সম্ভব দ্রুত জায়গা পাক এটাই চাইছে বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ এলাকারই দেবব্রত রায় প্রধান যেমন বললেন, "দেশ ভাগ হওয়ার আগের যেগুলি পাওয়া যায় সেই সব মানচিত্রে বেরুবাড়ির উল্লেখ আছে ৷ বাংলাদেশের মানচিত্রেও এর উল্লেখ ছিল । কিন্তু, এদেশের মানচিত্রে এখনও নেই ৷ বেরুবাড়ির মানুষ আন্দোলন করেছে ৷ তারা পাকিস্তানে যেতে চায়নি ৷ এই দেশেই থাকতে চেয়েছে ৷ 1974-র চুক্তি সেই অধিকার দিয়েছে কিন্তু আজও মানচিত্রে আমাদের জায়গা দেয়নি ৷ দেশে থেকেও আমাদের জমির মানচিত্রে না থাকাটা কষ্টের ৷"

জলপাইগুড়ি, 27 ফেব্রুয়ারি : "সরকারি সুযোগ সুবিধার মুখ সবে দেখতে শুরু করেছি ৷ ইদানিং রাস্তা-ঘাট হচ্ছে ৷ সবাই জানে আমরা ভারতের নাগরিক ৷ অথচ এদেশের ম্যাপে আজও আমাদের গ্রামের জমিগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়নি ৷"

"ওই জমিটা দেখতে পাচ্ছেন ? ওটা আমার ৷ ওখানেই আমি ফসল ফলাই ৷ সারাবছর খাটি ৷ কিন্তু, ওই জমি বিক্রির অধিকার আমার নেই ৷ বাড়িতে সুবিধে-অসুবিধে রয়েছে ৷ বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে বইকি মাঝে মাঝে ৷ কিন্তু, পারি না ৷ দেশে থেকেও সব সুযোগ সুবিধে পাচ্ছি না ৷"

Berubari
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুনের বেরুবাড়ি নিয়ে চুক্তি

জলপাইগুড়ি সদর ব্লক লাগোয়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেরুবাড়ি এলাকা ৷ প্রথম বক্তা দেবব্রত রায় প্রধান ৷ দ্বিতীয়জন সত্যেন রায় প্রধান ৷ দু'জনেই জানালেন এই সমস্যা শুধু তাঁদের নয় ৷ কয়েক দশক ধরে একই সমস্যায় ভুগছে দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের তরফে জানা গেছে, এই গ্রামগুলি আসলে অ্যাডভার্স পোজ়েশনের মধ্যে ছিল ৷ এখনও জমি জরিপের কাজ চলছে ৷ ফলে জমিগুলির মালিকরা হাতে কাগজপত্র পাননি ৷ জরিপ ও দুই দেশের মাঝে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শেষ হওয়ার পরই গ্রামের জমিগুলিকে ভারতের ম্যাপে আনা হবে ৷ তখন জমি বিক্রির অধিকারও পাবেন মালিকরা ৷ একই তথ্য দিলেন জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায় ৷ জানালেন, জমি জরিপ ও দুই দেশের মাঝে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শেষ না হলে অ্যাডভার্স পোজ়েশনের তকমা মুছবে না এই এলাকাগুলির ৷

Berubari
পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার দাবিতে বেরুবাড়ির আন্দোলন

কেন এই সমস্যা ? এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস ৷ 1947 সালে দেশ ভাগের পর বেরুবাড়ি কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নিয়ে সমস্যা দানা বাঁধে ৷ 1958 সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ চুক্তিতে ঠিক হয়, দক্ষিণ বেরুবাড়ির অর্ধেক অংশ পাকিস্তানকে দেওয়া হবে ৷ ফলে দক্ষিণ বেরুবাড়ির একটি নির্দিষ্ট অংশ তৎকালীন পাকিস্তানে চলে যায় । কিন্তু, নিজেদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ ভারতেই থাকার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তারা ৷ 1961 সালের 26 জানুয়ারি বেরুবাড়ির বাসিন্দারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রাণ থাকতে পাকিস্তানে যাবে না ৷ "রক্ত দেব প্রাণ দেব, বেরুবাড়ি ছাড়ব না", এই শ্লোগানকে হাতিয়ার করে চলতে থাকে আন্দোলন ৷ 1971 সালে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে বাংলাদেশ নামে এক আলাদা রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে ৷ প্রধানমন্ত্রী হন শেখ মুজিবর রহমান ৷ এবারে পরিস্থিতি ফের বদলায় ৷ 1974 সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে তিনবিঘা করিডোর চুক্তি হয় ৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ বেরুবাড়ির যে অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তা ভারতকে হস্তান্তর করা হবে ৷ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে দক্ষিণ বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ বেরুবাড়ি আন্দোলনের ফলেই ভারতে থাকার অধিকার পেল বলে মনে করতে থাকে তারা ৷

ম্যাপে নেই বেরুবাড়ি এলাকার বেশ কয়েকটি জায়গা

তবে এবার এক নতুন সমস্যা দেখা দেয় ৷ 1974-এর চুক্তি বেরুবাড়ির নির্দিষ্ট অংশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও জমি জরিপ ও সীমানা নির্ধারণের সময় সমস্যা তৈরি হয় ৷ দেখা যায়, ওই এলাকায় ভারতের এমন কিছু জমি আছে যেখানে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করছে আবার বাংলাদেশের কিছু জমিতে ভারতের লোকও বসে রয়েছে ৷ সেই জায়গাগুলিকে অ্যাডভার্স পোজ়েশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ এরকমই জায়গা হল এই চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ ফলে ওই এলাকার জমির জরিপ ও সীমান্ত নির্ধারণ না হওয়ায় ভারতের মানচিত্রে এলাকাগুলিকে জায়গা দেওয়া হয়নি ৷ ফলে ভারতে থাকার আন্দোলন শেষ হতে না হতেই আবারও সমস্যায় পড়ে বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ অ্যাডভার্স পোজ়েশন মধ্যে থাকায় বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে তারা ৷ প্রশাসনের তরফে বেরুবাড়ির মানুষকে আশ্বাস দেওয়া হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এই সমস্যার সমাধান হবে ৷

Berubari
2015-র ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিতে বেরুবাড়ির উল্লেখ

2015 সাল ৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ নির্ধারিত সীমায় কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শুরু হয় ৷ বেরুবাড়ির অ্যাডভার্স পোজ়েশনে কাজ শুরু করে প্রশাসন ৷ জমি জরিপ ও কাঁটাতার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় ৷ তবে ওই এলাকার মানুষের অভিযোগ, উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজ চলছে ধীর গতিতে ৷ কবে শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না ৷

Berubari
1974 সালে ইন্দিরা গান্ধি ও শেখ মুজিবর রহমানের চুক্তিপত্র

এই বেরুবাড়ির বাসিন্দা সত্যেন রায় প্রধান ৷ এখন বয়স হয়েছে ৷ বেরুবাড়ি সমস্যার প্রথম থেকেই সাক্ষী ৷ সেই তিনি জানালেন, "এখান থেকে বাংলাদেশ দেখতে পাই ৷ ওই যে জমি জরিপের কাজ শুরু হয়েছে ৷ এখনও চলছে ৷ দেখি কতদিনে কী হয় ৷"

দীপচরণ রায় যেমন বললেন, "এখানে স্কুল আছে ৷ রাস্তা আছি ৷ যত দ্রুত ভারতের মানচিত্রে আমাদের গ্রামগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে ভালো ৷ সেটা না হওয়া পর্যন্ত ঠিক ভরসা করতে পাচ্ছি না ৷ অনেকদিন ধরেই তো আমরা কষ্ট পাচ্ছি ৷ আমাদের জমির খতিয়ান নেই ৷ থেকেও যেন নেই ৷ বিক্রি বা কিনতে পারি না ৷ সরকার দেখুক ৷"

berubari
জমি থাকলেও তা বিক্রির অধিকার নেই

কাজ শুরু হলেও দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে না বলে অভিযোগ করলেন জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায় । তাঁর কথায়, "একসময় দক্ষিণ বেরুবাড়ির কিছু অংশ বাংলাদেশে ছিল । সেগুলো পরে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় । তবে সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে দুই দেশের সরকারই সমস্যায় পড়ে ৷ কিছু জায়গাকে অ্যাডভার্স পোজ়েশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ 2015-র ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পর জমি জরিপের কাজ নতুন করে শুরু হয় । এখন দুই দেশের মাঝে দেওয়া হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়াও । দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে কিন্তু, এখনও কাজ শেষ হয়নি । ফলে দেশে থেকেও মানচিত্রে নেই ওই এলাকার জমিগুলি । প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে । ''

কবে হবে জমি জরিপের কাজ শেষ ? কবে দেশের মানচিত্রে জায়গা পাবে বেরুবাড়ির সেই বিতর্কিত এলাকাগুলি ? জানতে জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের BDO তাপসী সাহার কাছে গেছিলেন ETV ভারতের প্রতিনিধি ৷ তাপসীদেবী বলেন, "ওই এলাকায় জমির সার্ভের কাজ শেষ হয়নি ৷ কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকায় ওখানকার মানুষ সমস্যায় পড়ছেন ৷ আমি বিষয়টি জানি ৷ ওই এলাকাগুলিতে এখন পাকা রাস্তা হয়েছে ৷ সরকারি সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে ৷ তবে মানচিত্রের বিষয়টি আমি বলতে পারব না ৷"

মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক অভিষেক তিওয়ারির কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "বিষয়টি নিয়ে আমি খোঁজখবর নেব ৷"

বেরুবাড়ির বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, মানচিত্রে জায়গা পায়নি একাধিক গ্রাম ৷ সেই তথ্য সবার জানা ৷ প্রশাসনের আধিকারিকরাও জানেন ৷ কিন্তু, এটা আন্তর্জাতিক ইশু, তাই প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না ৷

তবে তাদের গ্রাম মানচিত্রে যতটা সম্ভব দ্রুত জায়গা পাক এটাই চাইছে বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ এলাকারই দেবব্রত রায় প্রধান যেমন বললেন, "দেশ ভাগ হওয়ার আগের যেগুলি পাওয়া যায় সেই সব মানচিত্রে বেরুবাড়ির উল্লেখ আছে ৷ বাংলাদেশের মানচিত্রেও এর উল্লেখ ছিল । কিন্তু, এদেশের মানচিত্রে এখনও নেই ৷ বেরুবাড়ির মানুষ আন্দোলন করেছে ৷ তারা পাকিস্তানে যেতে চায়নি ৷ এই দেশেই থাকতে চেয়েছে ৷ 1974-র চুক্তি সেই অধিকার দিয়েছে কিন্তু আজও মানচিত্রে আমাদের জায়গা দেয়নি ৷ দেশে থেকেও আমাদের জমির মানচিত্রে না থাকাটা কষ্টের ৷"

Last Updated : Mar 7, 2020, 4:29 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.