জলপাইগুড়ি, 24 অগাস্ট : মেলা মানে "মুড়কি, মুড়ি, তিলেখাজা, পাঁপড়ভাজা"৷ মেলা মানে "বন্বনাবন্ নাগরদোলা" ৷ আর মেলা মানে অসংখ্য মানুষ ৷ পায়ে পায়ে পথ চলা ৷ বাঙালির প্রাণ যেন লুকিয়ে থাকে মেলায় ৷ বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গে কতশত মেলা যে সারা বছর হয় তার খবর কে রাখে ? কিন্তু আজ পৃথিবীতে নেমেছে অদ্ভুত বিষাদ ৷ কোরোনা আতঙ্কের জেরে মানুষের ভিতরের সব আনন্দ কে যেন চুরি করে নিয়েছে ৷
কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জেরে বন্ধ মেলা। আর এই মেলার সঙ্গে জড়িত কত মানুষের রুজিরোজগার সব স্তব্ধ হয়ে আছে ৷ ফলে বিপাকে পড়েছেন মেলার সাথে জড়িতে কয়েক হাজার শ্রমিক, মালিক, দোকানিরা। মেলা বন্ধ থাকায় মাঠে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে মেলার উপকরণ। মার্চ মাস থেকেই কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। এখনও সবকিছু স্বাভাবিক হয়নি । ধীরে ধীরে লকডাউনের উপর থেকে শর্ত সাপেক্ষে দোকানপাট খুলতে শুরু করলেও মেলা সহ যেখানে বেশি ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা তা বন্ধ রাখার কথা সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
মার্চ মাসে দোলের সাত দিন পর থেকেই উত্তরবঙ্গ ও নিম্ন অসমের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু এবার মেলা বন্ধ। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা কারও জানা নেই। এমন অবস্থায় কীভাবে সংসার চলবে তা ভেবেই দিশেহারা মেলার সাথে যুক্ত শ্রমিক থেকে শুরু করে দোকানিরা। কেউ কেউ মেলা বন্ধ থাকার কারণে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যাঁরা ভিন রাজ্য থেকে এই রাজ্যে মেলার সাথে জড়িত ছিল তাঁরা এখন কোনও রকমে দিনযাপন করছেন । মেলার মালিক যেমন পারছেন তাঁদের খাদ্য সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করছেন। কিন্তু কতদিন এভাবে চলবে জানেন না কেউই।
জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের বড় মেলার মালিক রয়েছেন ৮ জন(শিলিগুড়ি,ময়নাগুড়ি,ফালাকাটা)। এছাড়া ছোটো ছোটো মেলা অনেকেরই আছে। এক একটি মেলার সাথে প্রায় 1000 জন জড়িত। পরোক্ষ ভাবে আরও বেশি। এক একটি মেলার মধ্যে নাগরদোলা, ব্রেক ডান্স, ড্রাগন ট্রেন, কলম্বাস, টোরাটোরা, চানতারা, মিকি মাউস, জিভ, বাচ্চাদের মারুতি, বাচ্চাদের নাগরদোলা থাকে। বর্তমানে মেলা বন্ধ থাকায় মেলার আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র সব নষ্ট হতে বসেছে। কেউ কেউ মেলার সামগ্রী ঢেকে রাখার চেষ্টা করলেও সব সামগ্রী ঢেকে রাখা সম্ভব নয় ফলে প্রচুর জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে । জঞ্জালে ঢেকে গেছে মেলার নাগরদোলা থেকে শুরু করে বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের বিভিন্ন লোহার ও প্লাউডের সামগ্রী । মেলা আবার শুরু হলেও সব কিছু নতুন করে বানাতে হবে বলে মত মেলার মালিকদের । এছাড়া যাঁরা মেলায় খাবারের দোকান, সহ অন্যান্য দোকান বসান, তাঁরাও সমস্যায় পড়েছেন মেলা বন্ধ থাকার ফলে।
জানা যায় হোলির এক সপ্তাহ পর থেকেই মেলা শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে মার্চের শেষে তুফানগঞ্জ, রামপুরহাট, ময়নাগুড়ি পানবাড়ি, মাথাভাঙা, শিলিগুড়িতে মেলা হয়ে থাকে সেই মেলা এবার হয়নি। অন্যদিকে বৈশাখ মাসে বৈশাখি মেলা ছিল বিশেষ করে বড় মেলার মধ্যে জলপাইগুড়ি, ইসলামপুর, শিলিগুড়িতে এবার মেলা হয়নি। অন্যদিকে বড় রথের মেলা বলতে বীরপাড়া, নাগরাকাটা, মালবাজার, চালসা, শিলিগুড়ি চম্পাসারি, ময়নাগুড়িতেে এবার কোরোনা ভাইরাসের জন্য লকডাউনের ফলে মেলা হয়নি। শ্রাবণ মাসে শ্রাবণীমেলা ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি, জল্পেশে হয়ে থাকে ৷ সেটা এবার হয়নি । সামনেই বিশ্বকর্মা পুজো ৷ সেটাও হবে কি না সন্দেহ । অন্যদিকে দুর্গাপুজোতে বানারহাট, শিলিগুড়িসহ নানা জায়গায় বড় মেলা হয়ে থাকে।
এখনও পর্যন্ত কোনও জায়গার উদ্যোক্তারা মেলার মালিকদের সাথে যোগাযোগ করেনি। ফলে কোথায় মেলা ধরবেন কোথায় মেলা হবে তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন মেলার মালিক থেকে কর্মীরাই। মেলার এক মালিক ময়নাগুড়ির বাপ্পা পাল জানান, "আমরা আজ দিশেহারা ৷ কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এত মানুষ আমাদের মেলার উপর নির্ভর করে সংসার চালান তাঁরা আজ অসহায়। আমরা আর কতদিন চালাতে পারব। তাঁদের কমবেশি সাহায্য করছি ৷ তাতে করে সমস্যা সমাধান হবে না। আমাদের মেলার মাল পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এক মেলা থেকে অন্য মেলায় নিয়ে যাওয়ার ফলে মেলার জিনিস নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু এবার পাঁচ মাস ধরে মেলার সামগ্রী বিভিন্ন জায়গায় পড়ে রয়েছে। মাল নিয়ে আসতেও প্রচুর টাকা খরচ। বিরাট জায়গার প্রয়োজন হয় মাল রাখতে। নতুন করে মেলা শুরু হলে আবার সব বানাতে হবে। রং রোদ ঝড় বৃষ্টিতে চটে গেছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। সব মেশিন বসে থাকার ফলে চলবে কি না সন্দেহ আছে। সব মিলিয়ে আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।"
অন্যদিকে মেলার এক কর্মী শশী বারলা, মধুসূদন দে বলেন, "আমাদের এই করেই সংসার চলে। মেলা বন্ধ কীভাবে যে আমরা আছি আমরাই জানি । মালিক আমাদের সাহায্য করছে ঠিকই কিন্তু কতদিন আর করবেন। সরকার যদি সব খুলে দেয় তবেই সম্ভব। না হলে আমরা মারা যাব। আমরা বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছি না। আমরা চাই মেলা খুলে যাক ৷ আগের মতো সব ঠিক হোক ।"