জলপাইগুড়ি, 19 জুলাই : কিছুদিন আগেই, 13 জুলাই এশিয়াডে সোনাজয়ী স্বপ্না বর্মণের নির্মীয়মাণ বাড়িতে বনবিভাগের তরফে অভিযান চালানো হয়েছিল ৷ সেই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের বনবিভাগের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের প্রধান সঞ্জয় দত্ত ৷ স্বপ্নার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল বেশ কিছু কাঠের লগ । এরপরই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেছিল , "স্বপ্না ভালো মেয়ে, ভালো খেলে । ওর কোনও দোষ নেই । যে অফিসার অভিযানে গেছিলেন, তাঁকে বদলি করতে বলা হয়েছে ।"
আর এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামগুলির মানুষরা । স্থানীয়রা জানিয়েছেন, লকডাউনের সময়ে তাঁদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সঞ্জয়বাবু । জঙ্গলটাকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন তিনি । বেঁকে বসেছেন গ্রামগুলির তৃণমূলপন্থীরাও । এলাকার এক তৃণমূলকর্মীর কথায়, "আমরা সবাই তৃণমূল করি । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিই । আজ উনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন আমাদের জন্যই ৷ ফের ভোট আসছে ৷ আমাদের 10 মিনিটেও লাগবে না মুখ্যমন্ত্রীকে আসন থেকে সরিয়ে দিতে ৷ মুখ্যমন্ত্রী যদি রেঞ্জারের বদলির উপর স্থগিতাদেশ না দেন, তাহলে আমরা একটাও ভোট দেব না ।"
বনদপ্তরের রিপোর্ট বলছে, এখনও পর্যন্ত 775 জন বন্যপ্রাণী পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছেন তিনি । উদ্ধার করেছিলেন বন্যপ্রাণীর দেহাংশ, আগ্নেয়াস্ত্রসহ আরও অনেক কিছু । কেন্দ্রীয় সরকারের বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত অপরাধ দমনের সর্বোচ্চ সম্মানও পেয়েছিলেন তিনি । জঙ্গল বাঁচাতে তাঁর অবদান আন্তর্জাতিক স্তরেও স্বীকৃতি পেয়েছিল । রাজ্য সরকারও তাঁর কাজে যথেষ্টই খুশি ছিল । 2016 সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে হাতে সেরা রেঞ্জ অফিসারের সম্মান তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে । সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল । কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন । 16 জুলাই । 2020 সাল । রেঞ্জ অফিসার সঞ্জয় দত্তের বদলির নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ।
এলাকার মানুষরা বলেন, জঙ্গলটাকে হাতের তালুর মতো চেনেন সঞ্জয় দত্ত । নিজের সন্তানের মতো করে না কি আগলে রেখেছিলেন জঙ্গলটাকে । জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামগুলির মানুষ ভগবানের মতো মানে রেঞ্জার সঞ্জয় দত্তকে । 2015 সাল থেকে বৈকুন্ঠপুর বনবিভাগের বেলকোবা রেঞ্জের দায়িত্ব সামলেছেন । আজ প্রায় সাড়ে চার বছর হতে চলল । জঙ্গলের ভিতরে চোরাকারবারিদের আনাগোনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ।
এ যেন ঠিক সিনেমার মতো । আধিকারিকদের বদলির দাবিতে বিক্ষোভ তো প্রায়শই চোখে পড়ে । তবে বদলি আটকানোর জন্য এমন বিক্ষোভ কিন্তু সহজে চোখে পড়ে না । কিন্তু একজন রেঞ্জ অফিসারের বদলি আটকাতে কেন এত বিক্ষোভ স্থানীয়দের । তা বুঝতে গেলে সবার আগে যেটা জানতে হবে, তা হল জঙ্গলের জন্য কী কী করেছেন তিনি ।
বনদপ্তরের রিপোর্টে, সঞ্জয় দত্ত এই কয়েক বছরে 100 টিরও বেশি পাচারকারীদের গাড়ি বাজেয়াপ্ত করেছেন । 775 জন বন্যপ্রাণীর দেহাংশ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছেন । 2 টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ও 15 টি ক্লাউডেড লেপার্ডের চামড়া উদ্ধার করেছেন । এছাড়াও রিভলভার, রাইফেল ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র তো আছেই । চিতাবাঘের চামড়া উদ্ধার করেছেন 26 টি । 28 কেজি ওজনের হাতির দাঁত ও 20 টি প্যাঙ্গোলিন উদ্ধার করেছেন । এখনও পর্যন্ত প্রায় কয়েক কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করেছেন সঞ্জয় দত্ত । শুধু তাই নয়, মানস জাতীয় উদ্যানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার খুন করে পালিয়ে যাওয়া বন্যপ্রাণীর পাচারকারীদেরও গ্রেপ্তার করেছেন তিনি । বনদপ্তর সূত্রে খবর, তিনি যে পরিমাণ বন্যপ্রাণীর পাচারকারীদের পাকড়াও করেছেন বা বন্যপ্রাণীর দেহাংশ উদ্ধার করেছেন সঞ্জয়বাবু, দেশের মধ্যে এই কৃতিত্ব আর অন্য কোনও বন আধিকারিকের নেই ।
শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই নয়, একাধিক আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের পাণ্ডাদের গ্রেপ্তার করেছিলেন তিনি । নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকশো কুখ্যাত বন্যপ্রাণীর দেহাংশ পাচারকারীদের জেলে পাঠিয়েছেন । 2015 সালের 8 ডিসেম্বর বন্যপ্রাণ দিবসে রাজ্যস্তরের এক অনুষ্ঠানে লাটাগুড়িতে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিলেন বৈকুন্ঠপুর বনবিভাগের বেলাকোবার রেঞ্জার সঞ্জয় দত্ত । বন্যপ্রাণী সুরক্ষার জন্য তাঁকে ওই বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ।
পাশাপাশি বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর দেহাংশের পাচার রুখতে সঞ্জয় দত্ত ভালো কাজ করার জন্য তৎকালীন বনমন্ত্রী বিনয় কৃষ্ণ বর্মণ তাঁকে পুরস্কৃত করেছিলেন । শুধুমাত্র 2015 সালেই বন্যপ্রাণী পাচারকারী 120 জনকে গ্রেপ্তার করেছিলেন তিনি । বাজেয়াপ্ত করেছিলেন 38 টি চোরাচালানের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি । এছাড়া 3 টি গন্ডারের খর্গ, 10 কেজি ওজনের হাতির দাঁত, 6 টি চিতাবাঘের চামড়া, 362 টি চিতাবাঘের হাড়, 2 টি জীবিত পাঙ্গলিনও উদ্ধার করেছিলেন তিনি । একইসঙ্গে রেড স্যান্ড বোয়া সাপের বিষও উদ্ধার করেছিলেন সঞ্জয় দত্ত ।
এখানেই শেষ নয় । এরপর থেকে বন্যপ্রাণের নিরাপত্তায় অসামান্য অবদানের জন্য একের পর এক পুরস্কার পেয়ে গেছেন তিনি । 2016 সালের 26 অক্টোবর । বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের জন্য রাজ্য বনদপ্তরের সম্বর্ধনা পান তিনি । বোদাগঞ্জে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজ্যের সেইসময়ের বনমন্ত্রী বিনয় কৃষ্ণ বর্মণ ও রাজ্যের বন দপ্তরের শীর্ষকর্তারা সঞ্জয়বাবুকে সংবর্ধনা দেন । ওই বছরেই কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রকের ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর পক্ষ থেকে বিশেষ শংসা পত্র দেওয়া হয় তাঁকে । এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের রেঞ্জার সঞ্জয় দত্তকে "ক্লার্ক আর বাভিন ওয়াইল্ড লাইফ ল এনফোর্সমেন্ট অ্যাওয়ার্ড"-এ সম্মানিত করা হয় । আয়োজক সংস্থা ছিল অ্যামেরিকার অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ইন্সটিটিউট । জোহানেসবার্গের ওই অনুষ্ঠানে অবশ্য থাকতে পারেননি সঞ্জয়বাবু । তাই রাজ্যের তৎকালীন বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ ওই সংস্থার তরফে এই সম্মান তুলে দিয়েছিলেন সঞ্জয়বাবুর হাতে । ওই বছরেই বন্যপ্রাণীর দেহাংশ পাচার রুখতে ভাল কাজ করার জন্য বনবিভাগের সেরা রেঞ্জারের পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি । মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেই পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।
এরপর 2017 সালে রাজ্যের মুখ্য বনপাল তথা হেড অব দ্য ফরেস্ট ফোর্স প্রদীপ শুক্লা সঞ্জয়বাবুকে তাঁর কাজের জন্য প্রশংসা করে শংসা পত্র দেন ।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও অ্যাথলেট স্বপ্না বর্মনের বাড়িতে হানা দেওয়ার কারণে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয় সঞ্জয় দত্তকে । সেদিনের অভিযানে, স্বপ্নার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল বেশ কিছু কাঠের লগ । উত্তরবঙ্গের বনবিভাগের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের প্রধান সঞ্জয় দত্তের নেতৃত্বে পাতকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের স্বপ্নার ধিম পাড়ার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছিল । স্বপ্নার বাড়িতে শাল কাঠ চেরাই হচ্ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল । যদিও স্বপ্নাকে বলতে শোনা যায়, "আমরা কোনও চুরি করিনি, টাকা দিয়ে কিনেছি ৷" এরপরই বদলির নির্দেশ দেওয়া হয় সঞ্জয়বাবুর ।
আর এতেই অভিভাবকহীন হওয়ার আশঙ্কায় বেলকোবা রেঞ্জ । সঞ্জয়বাবুর বদলি নিয়ে কী বলছে বন সুরক্ষা কমিটি ?
বন সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোস্তাফা হোসেন চৌধুরি বলেন,"আমরা সঞ্জয় দত্তের বদলি কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছি না । কারণ, তিনি আমাদের জঙ্গলকে আগলে রেখেছিলেন । জঙ্গল লাগোয়া মানুষদের অভিভাবক ছিলেন । লকডাউনের সময় আমাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করেছিলেন । এমনকী, আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের পান্ডাদের গ্রেপ্তার করেছিলেন । আমাদের প্রচুর মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন । উনি চলে গেলে, আমাদের অনেক বিপদ হবে ৷ "
সঞ্জয় দত্তের মতো এমন দায়িত্ববান আধিকারিকের বদলি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে বিরোধী শিবিরও । BJP-র জেলা সহ-সভাপতি অলোক চক্রবর্তীকে এ-বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, "পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন চোরকে চুরি করতে বলছে আর পুলিশকে সজাগ থাকতে বলছে । গুনীজনের কদর নেই । শুধু ব্যবহার করছে । রাজ্যে সার্কাস চলছে । সঞ্জয় দত্ত একজন ভালো অফিসার । আইন আইনের পথে চলবে এটা স্বাভাবিক । অনেক রাঘব বোয়াল ধরা পরে যাবেন । তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী । এখন অনেক কিছু বেরোবে, তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হল । স্বপ্না আমাদের গর্ব । আমরা স্বপ্নার পাশে আছি । এখানে রাজনৈতিক কোনও বিষয় নেই । তবে তাঁর দোষ-গুন না দেখে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল । এটা ঠিক নয় । সঞ্জয় দত্ত ভালো অফিসার । লকডাউনের সময় তিনি যেভাবে সাধারন মানুষের সাহায্য করেছেন তা বলার নয় ।"
পরিবেশ প্রেমী বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরি প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, "বনবিভাগের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল । সঞ্জয় দত্ত জঙ্গলকে আগলে রেখেছিলেন । বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের ধরা থেকে শুরু করে জঙ্গল রক্ষার করার ক্ষেত্রে ভালো কাজ করছিলেন । তিনি বদলি হওয়ার পর নতুন যে আধিকারিক আসবেন তিনি কতটা কি করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ।" পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর পাচারকারীরাও এই সুযোগকে কাজে লাগাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরি ।
জলপাইগুড়ি গ্রিন ভ্যালি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পাপ্পু শীল বলেন, "সঞ্জয় দত্ত একজন দক্ষ অফিসার । আমাদের এই চত্বরের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল তাঁর বদলিতে । তিনি কয়েকশো পাচারকারীকে ধরেছেন । অনেক বন্যপ্রাণীর দেহাংশ উদ্ধার করেছেন । মুখ্যমন্ত্রী, বনমন্ত্রী তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন । আমরা রাজ্য সরকারের কোনও বিরোধীতা করছি না । তবে বিষয়টি ভালো হল না । সঞ্জয় দত্ত অনেক ভালো কাজ করতেন ।"
বেলকোবার আশেপাশের গ্রামবাসীদের এখন একটাই চিন্তা । সঞ্জয় দত্ত চলে যাওয়ার অন্য আধিকারিক কীভাবে কাজ করবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে । জঙ্গলকে তিনি যেভাবে আগলে রেখেছিলেন, অন্য কেউ কি তা পারবে ? এই প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে বেলকোবার আনাচে কানাচে ।