জলপাইগুড়ি, 27 জুলাই: ভারতেরই গ্রাম ৷ গ্রামের মানুষের আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড আছে ৷ তাঁরা নির্বাচিত করেন দেশের সাংসদ ও বিধায়কদের ৷ অথচ গ্রামের কোনও অস্তিত্বই নেই ভারতের মানচিত্রে ৷ তাই বিভিন্ন সরকারি সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পাঁচটি গ্রামের বাসিন্দা ৷ ভারতীয় নাগরিক হওয়ার পাশাপাশি জমির অধিকারও চান তাঁরা ৷ অথচ দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের দরবারে তদ্বির করেও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ ৷ আর এই পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছেন ওই এলাকারই বাসিন্দা প্রাক্তন বিধায়ক ৷
যে পাঁচ গ্রাম নেই ভারতের মানচিত্রে: জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রামপঞ্চায়েতের অন্তর্গত পাঁচটি গ্রাম - দক্ষিণ বেরুবারির কাজলদিঘি, চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতারিদেবোত্তর এবং পড়ানি গ্রাম ৷ এই গ্রামগুলিকেই ভারতের মানচিত্রে আনার দাবি তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা । আন্তর্জাতিক আইনি স্বীকৃতির অভাবে এই পাঁচটি গ্রামের মানুষ জমির খাজনা দেওয়া, জমি বিক্রি, সরকারি প্রকল্প ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন । জমির কোনও কাগজপত্র না থাকায় জমি বিক্রি করতে পারছেন না তাঁরা ৷ পাচ্ছেন না কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা । তাঁরা চাইছেন, সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে তাঁদের সমস্যার সমাধান করুক ।
ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ বেরুবাড়ি আন্দোলন: দেশের স্বাধীনতার পর ভারতের গণ আন্দোলনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হল বেরুবাড়ি আন্দোলন । দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলা আন্দোলনের মাঝে 1961 সালের 26 জানুয়ারি বেরুবাড়ি আন্দোলনে সংকল্প বেদি তৈরি করে লেখা হয়েছিল, "রক্ত দেব, জীবন দেব, বেরুবাড়ি ছাড়ব না"। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর 2015 সালে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে স্থলসীমা চুক্তির পর জমির অধিকার স্বীকৃত হলেও সেই স্বাদ আজও পায়নি বেরুবাড়িবাসী । তাঁরা এখনও জমির কাগজ হাতে পাননি ।
প্রশানসের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, এই গ্রামগুলি ভারতের মানচিত্রে আসতে চলেছে ৷ কিন্তু এখনও সেই আশ্বাস বাস্তব রূপ পায়নি । স্বাধীনতার পর ভারতে থেকেও ভারতীয় হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য ভোট দিয়ে আসছেন এই গ্রামগুলির বাসিন্দারা । কিন্তু আজও তাঁদের গ্রাম ভারতের মানচিত্রে নেই ৷
দীর্ঘদিনের সমস্যা: দীর্ঘ 76 বছর ধরে চলছে এই সমস্যা । এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্দোলন করে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা । ছিটমহল বিনিময়ের মতো 'স্টেটাসকো' বজায় রেখেই 2015 সালে দক্ষিণ বেরুবাড়ির এই পাঁচ গ্রামকে ভারতের মানচিত্রে 'আইনি স্বীকৃতি' দিয়েছে দু'দেশ ৷ দেশভাগের সময় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই পাঁচটি গ্রাম দক্ষিণ বেরুবাড়ির মধ্যে চলে আসে ।
আরও পড়ুন: আম-লিচু গাছই এখন সঙ্গী ছিটমহল আন্দোলনকারী অশীতিপর মনসুরের
যদিও 1989 সালে বোঝা যায় যে, ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে এলেও এই পাঁচটি গ্রামকে ভারতের মানচিত্রে দেখানো হয়নি । এই আন্তর্জাতিক আইনি স্বীকৃতির অভাবে পাঁচটি গ্রামের মানুষের জমির খাজনা আদায়, জমি বিক্রি, সরকারি প্রকল্প রূপায়ণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে । ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চিলাহাটি গ্রামে বাড়ি জলপাইগুড়ি সদর বিধানসভার প্রাক্তন ফরোয়ার্ড ব্লক বিধায়ক গোবিন্দ রায়ের । তিনি 2006 সালে এই এলাকার বিধায়ক হন ।
এলাকার বাসিন্দা প্রাক্তন বিধায়ক: গোবিন্দ রায় বলেন, "আমার জন্মভুমি চিলাহাটির ডাকের কামাত গ্রাম । কিন্তু আজ পর্যন্ত এখানকার মানুষের জমির কাগজ নেই । পাঁচটি গ্রামে 10 হাজার মানুষের বসবাস । আট হাজার ভোটার । রাজ্য সরকারের কৃষকবন্ধু প্রকল্প, কেন্দ্র সরকারের কিষান নিধি সম্মান প্রকল্পের সুবিধে গ্রহণ করতে পারছেন না এলাকার কৃষকরা । জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় জরিপ সম্পন্ন করে খতিয়ান দিতে হবে ।"
তিনি জানান, 1958 সাল থেকে বেরুবাড়ি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয় । 1974 সাল পর্যন্ত আন্দোলন চলে । ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর যখন মাপঝোঁক শুরু হল, তখন দেখা যায় ভারতের পাঁচটি গ্রাম বাংলাদেশের মানচিত্রে চলে গিয়েছে । আর বাংলাদেশের চারটি গ্রাম ভারতের মানচিত্রে এসে গিয়েছে ৷ এই জায়গাগুলিকে অ্যাডাভার্স পজিশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । এরপর 2015 সালে ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট তৈরি হয় ।
প্রাক্তন বিধায়কের কথায়, "আমরা জেলাশাসক, ব্লক ভূমি রাজস্ব আধিকারিক-সহ সবার কাছে দরবার করেছি । কিন্তু জরিপ করার মতো কর্মী তাঁদের নেই । স্পেশাল ব্যবস্থা করে জরিপ করে জমির খতিয়ান দেওয়ার দাবি জানিয়েছি । কিন্তু আট বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও রাজ্য বা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে কোনও তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করছি না ।"
চিলাহাটি গ্রামের রতন রায় জানান, "আমার 57 বছর বয়সে তারকাঁটার বেরা দেখতে পেলাম না । আজ পর্যন্ত জমি কেনাবেচা করতে পারছি না ।কোনও সার্ভে হয়নি । জমির কোনও খতিয়ান নেই । আমি শেষ জীবনে দেখে যেতে চাই যে আমরা ভারতের মানচিত্রে এসেছি । আমরা যাতে ভারতেই থাকতে পারি এটাই চাই । আধার কার্ড ভোটার কার্ড থাকলেও ভারতের মানচিত্রে আমরা নেই ।"
মরিঙ্গা পাড়া গ্রামের বাসিন্দা মুকুল রায় বলেন, "আমরা ভারতেরই নাগরিক কারণ ভোটার কার্ড, আধার কার্ড আমাদের সব আছে । এখানে থাকছি, ঠিকই আছে । কিন্তু জমির কোনও কাগজ নেই । কৃষকবন্ধু প্রকল্পও পাচ্ছি না । আমাদের দলিল নেই, খতিয়ান নেই ৷ স্ট্যাম্প পেপারের উপর জমি দখলের কেনা-বেচা হয় । আদৌও জমির কাগজ হবে কি না জানি না । কারণ এই জায়গাটা এখনও ভারতের মানচিত্রে ঢুকল না ।"
লক্ষ্মণ রায় বলেন, "কাঁটাতারের বেরা হলে আমাদের সুবিধা হবে । পিলার হয়ে গিয়েছে কিন্তু তারকাঁটার বেরা নেই । আমরা ভারতের মানচিত্রে নেই ।আমাদের জমির কাগজ নেই । আমাদের জমির রেজিস্ট্রি হয় না । স্ট্যাম্প পেপারে জমি দখলিস্বত্ব দেওয়া হয় । জমির অধিকার নেই আমাদের ।জমির সঠিক মুল্য পাচ্ছি না । কম দামে বিক্রি হয় তাও আবার স্ট্যাম্প পেপারে । আমাদের আগের বিধায়ক এই গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন ।"
আরও পড়ুন: দেশে আছে, ম্যাপে নেই !
স্থানীয় বাসিন্দা অনুকুল রায়ের কথায়, "সরকার বিনিময় করল । জিরো পয়েন্টে তারকাঁটার বেরা হলে সুবিধা হবে । আমাদের জমির কোনও খতিয়ান নেই । ভারত সরকার আমাদের গ্রামকে মানচিত্রে নেয়নি । জমির কোনও মূল্য নেই । আমাদের জমির খতিয়ান নেই, তাই আমরা সরকারের কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছি না ।"
কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে জানালেন জেলাশাসক: জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা এ প্রসঙ্গে জানান, দক্ষিণ বেরুবাড়ির কয়েকটি গ্রামের সমস্যা আছে । বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে ।