হাওড়া, 21 জুন : সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাসহ কলকাতাকে তছনছ করে দিয়েছে আমফান ঘূর্ণিঝড় । রাজ্যের ছ'টি জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে । হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন । তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্ষতি আরও কয়েক গুণ বাড়তে পারত, যদি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল না থাকত । ঝড়ের ভয়াবহতা এবং বিধ্বংসী রূপ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল ম্যানগ্রোভ । তা থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার ম্যানগ্রোভ রোপণ ও সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে ।
ইতিমধ্যে শিবপুর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বোটানিক্যাল গার্ডেনে ম্যানগ্রোভের হদিস পাওয়া যায় । বিষয়টি নিয়ে পরের দিকে গবেষণা শুরু করে দেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিশেষজ্ঞরা । তাঁরা বুঝতে পারেন, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ায় গঙ্গার জলে লবণের পরিমাণ বাড়ছে । সেজন্যই সুন্দরবনের লবণাক্ত জলে যে ম্যানগ্রোভ জন্মায়, তা জন্মাচ্ছে কলকাতা সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনেও । এরপরই বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় । বোটানিক্যাল গার্ডেনের দেড় কিলোমিটারেরও বেশি এলাকাজুড়ে বসানো হয় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ । সেই পরীক্ষা রীতিমতো সফল হয় । বাড়তে থাকে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ । ঘূর্ণিঝড় আটকাতে, ভূমিক্ষয় রোধে ম্যানগ্রোভের যে কী বড় ভূমিকা রয়েছে, তা বুঝতে পারেন বোটানিক্যাল গার্ডেন কর্তৃপক্ষ । সেই লক্ষ্যেই আগামী কয়েক বছরে আরও 3-4 হাজার ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বসানো হবে বলে জানিয়েছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বসন্ত সিং । তাঁর কথায়, আগামী 10 বছরের মধ্যে শহরের প্রাচীর তথা ম্যানগ্রোভ ওয়াল তৈরি করা হবে । এর মাধ্যমে কলকাতা-হাওড়া সংলগ্ন এলাকায় অনেকটাই প্রতিহত করা যাবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতিকর প্রভাবকে । সুন্দরবনের আদলে তৈরি এই ম্যানগ্রোভ গার্ডেন দর্শকদের আকর্ষণও বাড়াবে ।
কিন্তু কীভাবে ভয়ঙ্কর সাইক্লোনের সামনে দেওয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ম্যানগ্রোভ?
- সাইক্লোনের মোকাবিলায় ম্যানগ্রোভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । উপকূলীয় এলাকার মাটি লবণাক্ত, সেই সঙ্গে উপরের স্তর ক্ষয়িষ্ণুও । তাই নিজেদের ঠিক রাখতে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত নিজেদের শিকড় বিস্তার করে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ । শুধু তাই নয়, শিকড় বিস্তার হয় গাছের চারপাশের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে । অনেকটা জালের ন্যায় দেখতে হয় । মাটির গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় গাছগুলি অত্যন্ত মজবুত হয় । ফলে ঝড় যখন আছড়ে পড়ে, তখন ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে । বরং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঝড়ের মোকাবিলা করে এই প্রজাতির উদ্ভিদ ।
- ম্যানগ্রোভের একটি সহজাত ক্ষমতা হল ঝড়ের গতিপথ পালটে দেওয়া এবং তা অনেকটা অংশে ছড়িয়ে দেওয়া । ফলে সারি সারি ম্যানগ্রোভ শিল্ড বা ম্যানগ্রোভ ওয়ালে যখন সাইক্লোন এসে ধাক্কা খায়, তখন এই একমুখী ঝড়ের গতিপথ পালটানোর প্রবল সম্ভাবনা থাকে । ঝড় নির্দিষ্ট একদিকে না ধেয়ে এসে, চারপাশে ছড়িয়ে যায় । সেইসঙ্গে ঝড়ের গতিও কমে যায় । ফলে একমুখী ঝড় আছড়ে পড়লে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা, এক্ষেত্রে তা অনেকটাই কমে যায় । ম্যানগ্রোভ ওয়ালের পিছনে থাকা জনপদের অধিকাংশটাই রক্ষা পেয়ে যায় এই কারণে ।
- তবে এই ধরনের দেওয়াল তৈরি হওয়ার পিছনে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ঘনত্ব দায়ী । কীভাবে ঘনত্ব বাড়ে ম্যানগ্রোভের? এই ধরনের উদ্ভিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, গাছ থাকা অবস্থাতেই বীজের অঙ্কুরোদগম হয় । সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে অঙ্কুর সমেত বীজটি গাছের ঠিক নিচের মাটিতে পড়ে । যেখানে উদ্ভিদের শিকড়গুলি জালের ন্যায় বিস্তৃত থাকে । এরপর অঙ্কুরিত বীজগুলি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে এবং নতুন গাছের জন্ম দেয় । আর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ঘনত্ব বাড়তে থাকে । পৃথিবীর অন্যান্য বনাঞ্চলের তুলনায় যে কোনও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের গভীরতা বা ঘনত্ব এই কারণেই অনেক বেশি । বোটানিক্যাল গার্ডেন বা সংলগ্ন এলাকায় যদি এই ধরনের দেওয়াল তৈরি হয়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে শহরকে বাঁচাতে সক্ষম হবে ।
- সুনামি তথা বড় জলোচ্ছ্বাস আটকাতেও সক্ষম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল । কারণ এর শিকড়ের বৈশিষ্ট্য এবং বনাঞ্চলের ঘনত্ব । যেহেতু উপকূলীয় এলাকার মাটি ম্যানগ্রোভ ধরে রাখতে পারে, তাই জলোচ্ছ্বাসে ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা কমে ।
এবিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌগত হাজরা বলেন, "কলকাতা আগে থেকেই ম্যানগ্রোভের জায়গা ছিল । তাই এখানে ম্যানগ্রোভ জন্মানোটা নতুন কিছু নয় । হয়ত পুরানো কোনও ম্যানগ্রোভ জন্মে থাকতে পারে । তবে এখন ম্যানগ্রোভ শিল্ড বা ওয়াল তৈরি করাটা খুব সহজ কাজ নয় । ধীরে ধীরে ব-দ্বীপ ছোটো হচ্ছে । আপনি লক্ষ্য করলে দেখতে পারেন, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের দ্বীপগুলির পরিসরও কমছে । কিন্তু যদি সমুদ্রের স্তর বাড়তে থাকে, জলে ম্যানগ্রোভের সেডিমেন্ট কমতে থাকে, তাহলে ম্যানগ্রোভ জন্মানোর সংখ্যাও কমে যাবে । তবে কিছু ম্যানগ্রোভ- সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতা এগুলি অল্প লবণাক্ত মাটিতেই জন্মাতে পারে । গরাং জন্মানো সম্ভব নয় ।"
মানবজীবনে ম্যানগ্রোভের ভূমিকা কী? তিনি বলেন, "ম্যানগ্রোভ সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে নিজেদের মূলে ও পাতায় কার্বন সঞ্চয় করে রাখতে পারে । এটি একটি কার্বন ফ্যাক্টরির মতো । তাই মানুষকে বাঁচাতে, দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিরন্তর কার্বন সঞ্চয়ের কাজ করে চলেছে এই প্রজাতির উদ্ভিদ । এমন বন্ধু কেউ নেই বোধহয়, যে মাটির মধ্যে কার্বন জমা করে রাখছে । তাছাড়া মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেও ম্যানগ্রোভ নানা ব্যবহারে লাগে ।"
তিনি আরও বলেন, "ম্যানগ্রোভ যে কলকাতাকে বাঁচাতে পারে, এই মুহূর্তে এটা ভাবা অনেকটাই কঠিন । কারণ ম্যানগ্রোভের রোপণ ও তার পরিচর্যা আগে জরুরি । ম্যানগ্রোভের বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে আমাদেরই । যাতে সেগুলি সঠিক উচ্চতাসম্পন্ন হতে পারে এবং ম্যানগ্রোভ ওয়াল তৈরি করে শহরকে বাঁচাতে পারে । যেহেতু সাইক্লোনের হাওয়ার গতিবেগ মাটি ঘেঁষে যায় না, তাই ম্য়ানগ্রোভের বড় হওয়াটা অর্থাৎ উপযুক্ত উচ্চতা জরুরি ।"
তাই আগামীদিনেও শহর ও উপকূলের এলাকাকে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাতে পারে এই ম্যানগ্রোভ । তবে এক্ষেত্রে ম্যানগ্রেোভ রোপণের মাধ্যমে সেই প্রতিরক্ষার ওয়াল গড়ে তুলতে হবে । ম্যানগ্রোভকে বাঁচাতে হবে । তবেই আমাদের সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত হবে ।