হুগলি/বর্ধমান, 26 এপ্রিল : কৃষকদের সুবিধার্থে কিষাণ মান্ডি তৈরির পরিকল্পনা করেছিল রাজ্য সরকার (Bengal Government's Flagship Programme Kisan Mandi) ৷ জেলায় জেলায় তৈরিও হয়েছিল অনেক কিষাণ মান্ডি ৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মান্ডিগুলি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে ৷ ফলে কোথাও ভরে গিয়েছে আগাছার জঙ্গল ৷ কোথাও আবার কোনও স্টোর কিংবা গ্যারেজ তৈরি হয়েছে ৷ কোথাও কোথাও তো শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে এই কিষাণ মান্ডিগুলি ৷ রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমান হোক, কিংবা বাংলায় কৃষি আন্দোলনের আঁতুরঘর সিঙ্গুর - সর্বত্রই ছবিটা এক বলে অভিযোগ (Kisan Mandis Fails to Serve Purpose in West Bengal) ৷
প্রশাসনের একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, বাংলায় 186টি কিষাণ মান্ডি তৈরির পরিকল্পনা করে রাজ্য সরকার ৷ বরাদ্দ হয় পাঁচ কোটি টাকা ৷ সেই মতো বিভিন্ন জেলায় তা তৈরিও হয় ৷ হুগলির 11টি ব্লকের মধ্যে 10টি কৃষক মান্ডি রয়েছে । সিঙ্গুরে একটি সুফল বাংলাও করেছে সরকার । তার মধ্যে আরামবাগ, সপ্তগ্রাম ও পুরশুড়ার কিষান মান্ডিগুলির অবস্থা শোচনীয় বলে অভিযোগ ৷ সেখানে কৃষকদের দেখা মেলে না ৷ কিছু গোডাউন ছাড়া কিছুই নেই । সরকারি তরফে জানানো হয়েছে, ঠিকমতো ক্রেতা-বিক্রেতা না থাকায় কিষাণ মান্ডি অচল হয়ে যাচ্ছে । তার মধ্যেও পুরশুড়াকে সচল করার চেষ্টা হলেও আরামবাগ ও সপ্তগ্রামে এই বাজার মূল্যহীন হয়ে পড়েছে ।
পূর্ব বর্ধমানের পরিস্থিতিও কার্যত এক ৷ এই জেলায় 23টি ব্লকে মোট 20টি কিষাণ মান্ডি গড়ে তুলেছে জেলা প্রশাসন । কিন্তু 20টির মধ্যে আজ পর্যন্ত চার-পাঁচটা বাদ দিয়ে বাকি কোনও কিষাণ মান্ডি চালু করা হয়নি । ফলে সেগুলি কার্যত ফাঁকা অবস্থায় পড়ে আছে । দিনের পর দিন এইভাবে পড়ে থাকার ফলে সেখানে আগাছায় ভরে গিয়েছে ।
সেখানে মাঝেমধ্যে সহায়ক মূল্যে ধান কেনাবেচা, করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া-সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে । বর্ধমানের রায়না ব্লকে যে কৃষক বাজার আছে, সেখানে শাসক দলের একটা 'কার্যালয়' গড়ে তোলা হয়েছিল । যদিও সেই কার্যালয় গত বছরের শেষ নাগাদ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে দাবি শাসক দলের ।
ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের মতে, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী এইগুলো গড়ে তুলতে পারলে সেগুলোতে স্থায়ীভাবে তাঁরা ব্যবসা করার সুযোগ পেতেন । কারণ, ফুটপাতে তাদের বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে হয় । ফলে এরকম জায়গা তাঁরা পেলে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারতেন ।
অপরিকল্পিত ভাবে সঠিক জায়গায় না করায় মান্ডিগুলি চাষিদের কোনও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ করছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ৷ তাদের দাবি, এগুলি সরকারি অর্থের অপব্যয় ৷ যদিও আগেই তারা এই দাবি তুলেছিল ৷ তাদের দাবি ছিল, মূলত যেসব এলাকায় কিষাণ মান্ডি গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই জায়গাগুলি লোকালয় থেকে অনেক দূরে । ফলে এই সব জায়গায় ব্যবসা করতে হলে কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হবে । এমনকি তারা এই প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আদৌ কৃষকেরা ওই সব কিষাণ মান্ডিতে ব্যবসা করতে যাবেন তো ! কার্যত সেটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে অনেক জায়গায় ৷
হুগলির নিয়ন্ত্রিত বাজারের সম্পাদক এস এফ রহমান বলেন, ‘‘হুগলির 11টি কৃষক বাজারের মধ্যে সাতটি কৃষক বাজার ভালো ভাবেই চলছে । শুধুমাত্র আরামবাগ এবং সপ্তগ্রাম জায়গার কারণে কৃষকরা যেতে চাইছেন না । পুড়শুড়া কৃষক বাজারটা খুব শীঘ্রই চালু করা হবে । সপ্তগ্রাম কৃষক বাজারের কলার বাজার প্রথম দিকে শুরু হলেও পরবর্তীকালে ক্রেতা-বিক্রেতা আসছেন না । তাই চলছে না । ওটা সরকারি তরফে আবেদন জানানো হয়েছে মাছের প্রসেসিং ইউনিট তৈরি করার জন্য । এছাড়া ওখানে ধান কেনাবেচার ব্যবস্থা আছে, কৃষক বাজারে বেশ কিছু দোকান থাকলেও থাকতে পারে তাতে কোনও সমস্যা নেই । সরকারি অফিস ছাড়া অন্য কোনও অফিস নেই বলে জানিয়েছেন নিয়ন্ত্রিত বাজারের সম্পাদক ।
হুগলি জেলা কৃষি সেচ সমবায়ের কর্মাধ্যক্ষ মনোজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কিছু কিছু জায়গায় কিষাণ মান্ডিগুলি তৈরি হয়েছিল । সেখানে কৃষকরা তাঁদের ফসল নিয়ে যাচ্ছেন না । যাতে তাঁরা যান, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে । কোনও সমস্যা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে । আর মান্ডির মধ্যে দোকান থাকলে ভালো, তাতে চাষিরা নিজেরাই কিনে নিয়ে যাবে । সেই জন্যই এই চিন্তাভাবনা ।’’
অন্যদিকে পূর্ব বর্ধমান জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কিষাণ মান্ডিগুলি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি । সেখানে যে সব দোকান ঘর পড়ে আছে, কোনও ব্যবসায়ী নিয়ম মেনে সেই দোকান ঘর ভাড়া নিতে পারেন ।
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা রায়নার বিধায়ক শম্পা ধাড়া বলেন, ‘‘জেলা 23টি ব্লকের মধ্যে 20টি ব্লকে কিষাণ মান্ডি গড়ে তোলা হয়েছে । এর মধ্যে বেশ কিছু কিষাণ মান্ডি এখন বন্ধ আছে । কিভাবে সেগুলি চালু করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে । তবে কিষাণ বাজারগুলিতে ধান কেনাবেচা হয় ।’’
রায়নার কিষাণ মান্ডিতে তাঁর অফিস থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সেখানে আমার কোনও কার্যালয় ছিল না । সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য একটা কার্যালয় ছিল । কিন্তু সেটাও অনেকদিন যাবত বন্ধ আছে ।’’
এই নিয়ে হাওড়ার কৃষি কর্মাধ্যক্ষ রমেশ চন্দ্র পাল বলেন, ‘‘হাওড়াতে 10টি কিষাণ মান্ডি রয়েছে, তার মধ্যে বেশিভাগ মান্ডিতে ধানের বিক্রি হয় । তার মধ্যেও উলবেড়িয়ার পাঁচারুলে একটি কিষাণ মান্ডিতে সমস্যা আছে । লোকালয় থেকে মান্ডিটি দূরে হওয়ার কারণে চাষিরা ওখানে পৌঁছাতে পারছে না । এক্ষেত্রে জায়গা নির্বাচন সঠিক না হওয়ার কারণে মান্ডিগুলি সমস্যা হচ্ছে ।’’
আরও পড়ুন : বন্ধ হয়ে পড়ে আছে কোচবিহারের অধিকাংশ কিষান মান্ডি