হুগলি, 29 জুলাই : করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ রাজ্যের হস্তশিল্প মেলা-সহ অন্যান্য মেলাগুলি । একই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে সরকারি সবরকম প্রদর্শনী । তাতেই বিপদে পড়েছেন রাজ্যের হস্তশিল্পীরা । জিনিসপত্র তৈরি করলেও বাজারে বিক্রি নেই । ফলে নতুন করে কাজও পাচ্ছেন না শিল্পীরা ৷ আর তার জেরেই দিনে দিনে বাড়ছে বেকারত্ব । সমস্ত সরকারি মেলা ও হাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আরও বেশি সমস্যায় পড়েছেন হস্তশিল্পীরা । তাই তাঁরা সরকারি সাহায্যের আবেদন করেছেন । এই পরিস্থিতিতে হস্তশিল্পের তৈরি জিনিস বিক্রি করতে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমকে ব্যবহার করতে চাইছেন শিল্পীরা ৷ তাই সরকারি তরফে যাতে এই অনলাইন ব্যবসার প্রসার ঘটানো হয় সেই আর্জি জানানো হয়েছে ৷ তাহলেই জেলা তথা রাজ্যের হস্তশিল্পের এই দুর্দশা ঘোচানো সম্ভব হবে ৷ উপকৃত হবেন বহু শিল্পী ৷
হুগলি জেলায় নানা ধরনের হস্তশিল্পী আছেন । বাঁশ, পট, ফাইবার, জুট ও পলিমার দিয়ে তাঁরা নানা ধরনের শিল্প ও কারুকার্যের সঙ্গে যুক্ত । হুগলি জেলায় সরকারিভাবে হাজারের বেশি হস্তশিল্পীর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে ৷ যাঁদের মধ্যে 400 জন শিল্পী বিভিন্ন সরকারি মেলা ও হাটের সঙ্গে যুক্ত । তাঁরা সাধারণ সময়ে বছরে প্রায় 52টি সরকারি মেলায় অংশ নেন । যে মেলাগুলিতে রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পী এবং ব্যবসায়ীরা আসেন । সেখান থেকেই যোগাযোগের মাধ্যমে সারাবছর ব্যবসা হয় শিল্পীদের ৷ কিন্তু, করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর থেকে প্রায় সবকিছুই বন্ধ হয়ে গিয়েছে । করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে সেই উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন শিল্পীরা । অনেকেই ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছিলেন। কিন্তু, ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় সমস্যায় পড়েছেন । সরকারি স্বীকৃত শিল্পীরা ছাড়াও একাধিক শিল্পী হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন । বর্তমানে তাঁদেরও রুটিরুজির টান পড়ছে । এই সময় কী করা উচিত তা কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না । তাই শিল্পীরা চান সরকার তাঁদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসুক । তা না হলে এই ছোট শিল্পগুলি আর্থিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷
এমনই এক শিল্পী গণেশ ভট্টাচার্য । তিনি অসম থেকে আনা বাঁশ দিয়ে নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং শো-পিস তৈরি করেন । তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে কুটির শিল্পের যে চর্চা ছিল, সেটা বর্তমানে নেই বললেই চলে । আগে শিল্পমেলায় যে জিনিসপত্র বিক্রি হত, করোনা পরিস্থিতির জেরে তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ আমরা পুরোপুরি ঘরের এককোণে চলে গেছি । সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবসা করে যেটুকু অর্থ উপার্জন হচ্ছে । তা আহামরি কিছু নয় । এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ৷ আগামী দিনে কী পরিস্থিতি হবে, আমরা এখনই বলতে পারছি না ।’’
পাটের আঁশ দিয়ে মূর্তি, পাখি সহ বিভিন্নরকম কারুকার্য ফুটিয়ে তোলেন ব্যান্ডেলের স্বপন ভট্টাচার্য। তিনি সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার শ্রমিক ছিলেন । কারখানা বন্ধ হওয়ার পর পাট দিয়ে বিভিন্ন থ্রি-ডি শিল্প তৈরি করেন । পাটের আঁশকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে রকমারি মডেল তৈরি করেছেন স্বপনবাবু । রাজ্যস্তরে পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি । বলেন, ‘‘পেটের টানে পাটের গণেশ তৈরি করি । কখনও ভাবতে পারেনি উৎকর্ষ মানের জিনিসপত্র তৈরি করতে পারব । তার পর আমার শিল্পকর্ম হুগলি জেলা ইনফর্মেশন কর্পোরেশন (DIC)-তে প্রতিযোগিতার জন্য জমা দিই । রাজ্যস্তরে পুরস্কার পাই । এটাকেই রুটিরুজি করে যেটুকু সংসারের স্বাচ্ছন্দ ফিরছিল, করোনা সব ভেস্তে দিয়েছে । যেটুকু সঞ্চয় করেছিলাম সেটাও শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ বর্তমানে সরকার যদি কিছু করে, তবেই আমাদের কিছু সুরাহা হবে ৷ পাটের আঁশ দিয়ে কাকাতুয়া, ময়ূর ,দুর্গার মুখ, গণেশ ও প্রকৃতির রূপ ফুটিয়ে তুলি ৷ রাজ্যে গোটা চারেক সরকারি মেলায় সেগুলিকে বিক্রি করে সারা বছর চলে যেত আমার । এই কাজ করতে লোন নিয়েছিলাম, সেটাও শোধ করতে পারিনি এখনও । বাড়িতে এক লক্ষ টাকার পাটের জিনিসপত্র তৈরি করা আছে, বিক্রি হয়নি ৷ করোনা পরিস্থিতিতে এই ধরনের হস্তশিল্প বিক্রি না হলে, ব্যাংকের ঋণশোধ করব কি করে বুঝে উঠতে পারছি না ।’’
আরেক শিল্পী পার্থ সাহা ৷ তিনি পলিমার ক্লে দিয়ে নানান ধরনের অ্যাবস্ট্রাক্ট মূর্তি তৈরি করেন ৷ ক্যানভাসের উপর পলিমার ক্লে দিয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, বিভিন্ন মডেল, পেন স্ট্যান্ড, ফুলদানি সহ একাধিক জিনিস তৈরি করেন তিনি ৷ তাঁর তৈরি শিল্পকলা শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, ভিন রাজ্যেও পাড়ি দেয় । সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর এই শিল্পকর্ম বিক্রি করেন ৷ আর এই কাজের সঙ্গে মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে মোট 30 জন যুক্ত আছেন । শিল্পী পার্থ সাহা বলেন, ‘‘করোনায় বাজারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ । লকডাউনে প্রায় বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে ৷ কারখানার কর্মীদের বাঁচানোর জন্য ধারে জিনিস দিতে হচ্ছে ৷ যে করেই হোক টিকে থাকতে হবে আমাদের এই বাজারে । সরকারি মেলা করে যেটুকু সাহায্য পাই, সেটুকুই ভরসা । আমরা শিল্পী হয়ে অনলাইনে সরাসরি বিক্রি করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হয় ৷ আমার এই কাজ মাদ্রাস, পুণে ও মুম্বই সহ নানা জায়গায় যায় ৷’’
হুগলি জেলা শিল্পকেন্দ্র সমূহের আধিকারিক সুমনলাল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হুগলি জেলায় এগারোশো জন সরকারি নথিভূক্ত শিল্পী আছেন । 450’র উপর শিল্পী সরকারি মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকেন । করোনার জন্যে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ৷ সেজন্য সরকারও চিন্তাভাবনা করছে ৷ এই শিল্পীদের তৈরি হস্তশিল্প কীভাবে আমাজন, ফ্লিপকার্ট সহ অনলাইন বাজারে বিক্রি করা যায় ৷ তার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে ৷ ইতিমধ্যেই শিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্রের ছবি নাম সহ নথিভূক্ত করা হচ্ছে ৷ এছাড়াও, জেলাশাসকের অফিসে প্রদর্শনীর আয়োজন করে, বিক্রির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে । আগামী দিনে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার মেলা শুরু হবে ।’’