চন্দননগর, 25 মে : সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ফরাসি ঐতিহ্য (Chandannagar French Institute losing historical glory due to negligence)। যে চন্দননগরে ফরাসিরা একদা উপনিবেশ তৈরি করেছিল । যার নানা ইতিহাস ছড়িয়ে আছে গোটা চন্দননগর জুড়ে । সেই ইতিহাসের সাক্ষী ফরাসি মিউজিয়াম বা ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট তা আজ ধংসের পথে ।
1812 সালের ফরাসি বাস্তু কলায় নির্মিত ডুপ্লে মহলের এখন ভঙ্গপ্রায় দশা । সেই আমলের তৈরি মূল্যবান গ্রন্থাগার, ফরাসিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র থেকে স্বাধীনতা আমলে নথিতে এখন ধুলো জমেছে । রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে সব কিছুই । নিরাপত্তা জন্য নেই কোনও নাইট গার্ড বা সিসিটিভি ক্যামেরা । যে কোন সময় এই সমস্ত মূল্যবাণ জিনিসপত্র চুরি হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সেখানকার অস্থায়ী কর্মীরা । বর্তমানেও এই ইনস্টিটিউটে ফরাসি ডিপ্লোমা কোর্সে পড়ানো হয় । সঠিক ক্লাস করানো হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে । অল্প পয়সায় শিক্ষক নিয়োগের ফলেও ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনার ঘাটতি রয়েছে বলেও অভিযোগ ।
চন্দননগর 1950 সালে স্বাধীনতা লাভ পাওয়ার পর থেকে এই মিউজিয়াম ভারতের দখলে আসে । ভারতীয় পতাকা তোলা হয় । সেই জাতীয় পতাকার এক অংশ এখন ছিঁড়ে গিয়েছে । সেই ছিন্ন বিছিন্ন পতাকাই উড়ছে ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউটে (Chandannagar French Institute)। কেউ দেখার নেই । কোনও অফিসার থাকে না । চারজন স্থায়ী ও 5 জন অস্থায়ী কর্মী থাকলেও, এত বড় ইনস্টিটিউটে চালাতে সক্ষম নয় তাঁরা । না আছে লাইব্রেরিয়ান, না আছে কিউরেটর । একজন ডিরেক্টর থাকলেও, তিনি সপ্তাহে একদিন আসেন । দীর্ঘদিন ডেপুটি ডিরেক্টর পদ শূন্য হয়ে রয়েছে ।
আরও পড়ুন : Paray Paray Didibhai : আসানসোলবাসীদের জন্য অগ্নিমিত্রার পাড়ায় পাড়ায় দিদিভাই !
ঐতিহাসিক এই মহলের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ (ASI)দেখভালের কথা থাকলেও, দীর্ঘদিন হয়ে গেল তা তত্ত্বাবধান করা হয়নি । রাজ্য উদ্যান পালন দফতরের দায়িত্বে থাকা ডুপ্লে ভবনের বাগান রক্ষণাবেক্ষণের কর্মী রাখার কথা, সে পদও ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে । কোন যত্ন হয় না এই বাগানের । বিশাল গাছের ডাল শুকনো হয়ে আছে, গাছের গোড়ায় অবস্থাও ভাল নয় । যে কোন সময়ে গাছ ভেঙে ঐতিহাসিক আবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাও দেখার কেউ নেই । সেই সঙ্গে ভিতরের ফ্রেঞ্চ মিউজিয়ামও রাজ্য সরকারের দখলে । সেখানেও অর্থ বরাদ্দ-এর অভাবে সিসিটিভি লাগানো ও অন্যান্য কাজ স্তব্ধ হয়ে রয়েছে । নতুন করে মিউজিয়ামকেও সাজানো হচ্ছে না ।
তবে এ বিষয়ে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে সেভাবে কিছু বলতে চাননি । ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউটের এরকম দশা দেখে লজ্জিত চন্দননগরবাসী । সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে আশা বহু পর্যটক আশাহত হন এই দুরবস্থা দেখে । যারা ইতিহাস নিয়ে পড়েন তাঁরা গবেষণার জন্য এখানকার গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারেন না । এখানকার অস্থায়ী কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই চান এর এই ঐতিহাসিক স্থানের উন্নতি হোক । বিশেষ করে চন্দননগর সরকারি কলেজের ফরাসি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ইনস্টিটিউটে ফরাসি পড়াশোনার মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন । তাঁর দাবি, সরকার এ বিষয়ে নজর দিক । নইলে আগামিদিনে চন্দননগরের এত বড় ঐতিহ্য ধ্বংসের পথে চলে যাবে ।
চন্দননগরে ফরাসিরা মোগল বাদশার কাছ থেকে 40,000 মুদ্রার বিনিময় 1688 খ্রিস্টাব্দে কুঠি স্থাপন করেন । পরে চন্দননগর গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত মনোরম প্রাসাদের ফরাসি উদ্যানবাটী তৈরি করা হয় । ফরাসি উপনিবেশের শাসকের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই প্রাসাদ । সামনে বারান্দায় অনেকগুলি সারিবদ্ধ স্তম্ভ রয়েছে । প্রাসাদের চারিদিকে সেটাও নষ্ট হচ্ছে এই সময় । ছাদের উপরের কাঠের একটি সুন্দর চালা রয়েছে, সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে । ছাদও নষ্ট হয়ে গিয়েছে, বৃষ্টি হলে জল পরে । এই স্মারকটি তৎকালীন ফরাসি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপনিবেশের গুরুত্ব বহন করে । এখানে হল ঘরে নানা ইন্দো-ফ্রেঞ্চ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত, তাও এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে ।
ইনস্টিটিউটের একজন অস্থায়ী কর্মী দেবকুমার শীল বলেন, "এখানে রক্ষণাবেক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই । বর্তমান ডিরেক্টর আছেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় তিনি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন । কিন্তু কিছু করা যায়নি । হেরিটেজ সংস্থার শুভাপ্রসন্ন মজুমদারকে জানিয়ে কোনও ফল হয়নি । এখানে নিরাপত্তার জন্য কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই । আমরা চাই চন্দননগরের ঐতিহাসিক এই স্থানটির উন্নতি হোক । বিভিন্ন মানুষ ও বিদেশী মানুষরাও দেখতে এসে ফিরে যায় এখান থেকে ।"
চন্দননগর সরকারি কলেজের ফরাসি বিভাগের প্রধান বাসবী পাল বলেন, "ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এখানের দায়িত্বে আছে, ডিরেক্টরও আছেন । কিন্তু দুঃখের বিষয় শিক্ষা ব্যবস্থার এডুকেশনাল হেড নেই । ডেপুটি ডিরেক্টর-এর পদ শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে । চন্দননগর সরকারি কলেজের ফরাসি বিভাগের প্রধানই ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউটের শিক্ষাব্যবস্থার দেখা উচিত এটা চিরকালের প্রথা । আমাদের পড়াশোনার চলাকালীন তাই দেখে এসেছি । সরকারি অর্ডার না থাকার কারণেই ওখানে গিয়ে কাজ করাও সম্ভব হচ্ছে না আমার পক্ষে । ফ্রান্স ও ভারতের মধ্যে চুক্তির বন্ধন আছে এই পর্যন্তই, তাঁরা আতিথিয়তা না পেলে তাঁরাও এখানে যুক্ত হতে পারছেন না । সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের যে বিষয়টা চন্দননগর থেকে হত, সেটা হয়ত আমরা চাইছি না । তাই জন্য ফ্রান্স ডেলিগেটরা সমাদৃত হচ্ছেন না ইনস্টিটিউটে ।"
আরও পড়ুন : Piyali Basak Conquers Mount Everest: টাকার 'পাহাড়ে' আটকে পিয়ালীর এভারেস্ট জয়ের স্বীকৃতি
পড়াশোনার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফরাসি বিভাগের প্রধান । তিনি আরও বলেন, "এই ইনস্টিটিউটের মতো পূর্ব ভারতে এই ধরনের পাঠাগার কোথাও নেই । রিসার্চ সেন্টারকেও আমরা আটকে দিয়েছি । ওখানে যে গভর্নিং বডি আছে, সেটাও মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে দশ বছর হল । মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন যে এই এত বড় ঐতিহ্যটাকে রক্ষা করার জন্য তিনি হস্তক্ষেপ করুন । ফরাসির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন হত ভারতবর্ষের, সেটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে । ফ্রান্স ও ভারতের মৈত্রীর বন্ধন আছে, সেটা নষ্ট হচ্ছে ৷ সেই সঙ্গে সংস্কৃতিক পীঠস্থান এই ইনস্টিটিউট, এটা নষ্ট হয়ে গেলে চন্দননগর তার ঐতিহ্য হারাবে ।"