হুগলি, 31 অক্টোবর: পনেরো বছর পর ফের প্রাসঙ্গিক সিঙ্গুর ও টাটার কারখানা ৷ ওই কারখানা টাটা গোষ্ঠী না করতে পারায় তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল ৷ সোমবার সন্ধ্যায় এই বিষয়টি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গ রাজনীতিতে হইচই পড়ে গিয়েছে ৷ সিপিএম স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর পর অস্ত্র পেয়ে গিয়েছে ৷ আর বিজেপি যারা সেই সময় জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে তৃণমূল নেত্রীর পাশেই ছিল, তারা এখন সুযোগ বুঝে সিঙ্গুরে শিল্প না হওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দুষছে ৷
হুগলি সিপিএমের এক নেতার দাবি, তাঁদের সরকার কারখানা করার চিন্তাভাবনা করে বেকার সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছিল । কিন্তু ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করে সব শেষ করে দেওয়া হচ্ছে । এটা কারও জয় পরাজয় নয় । আখেরে এর ক্ষতিপূরণ রাজ্যবাসীকেই দিতে হবে । হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, শিল্পকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিশাপ বাংলার মানুষকে পেতে হচ্ছে । আর সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের সঙ্গী সিঙ্গুরের প্রাক্তন বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, টাটারাও চলে গিয়েছে এটা শুধু সিঙ্গুরের দুর্ভাগ্য নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য ।
সিঙ্গুর নিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে হুগলির সাংসদ বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য: এই নিয়ে লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই রায়ে প্রায় 1700 কোটি টাকা রাজ্যকে দিতে হবে । এদিকে না হয়েছে শিল্প, না কৃষকরা ফেরত জমি পেল । সরকার এই টাকা কীভাবে দেবে? দিতে হলে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিতে হবে । রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা প্রত্যেকটা দল যেমন সিপিএম নিজের মতো রাজনীতি করে গিয়েছে । এরপর তৃণমূল নিজের মতো রাজনীতি করেছে । কিন্তু আখেরে কোনও লাভ হয়নি রাজ্যের ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘জমি ফেরত দেওয়ার নাম করে এরা শিল্পটাকে বন্ধ করেছে । বেকারের চাকরি হত। সেই সময় বেকার যুবকরা ট্রেনিং নিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে গুজরাত-উত্তরপ্রদেশ চলে গিয়েছে । এতো বছর পরেও এতকিছু হওয়ার পর টাটাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে । বর্তমানে রাজ্যে কোনও শিল্প নেই । বেকারদের চাকরি নেই । আমরা চাই শিল্প হোক পশ্চিমবঙ্গে ।’’
এই নিয়ে তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘শিল্পকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিশাপ বাংলার মানুষকে পেতে হচ্ছে । আমরা আবারও চাই সিঙ্গুরের টাটা গোষ্ঠী আসুক । আবার কারখানা তৈরি হোক। সিঙ্গুরের চাষিরা জমি ফেরত চান না । কারণ, সেই জমির অবস্থা ঠিক নেই । আমরা জানি তৃণমূল সরকার আবার এর জন্য আদালতে যাবে । যে ভুল তারা করেছে সেই ভুলের মাশুল তাঁদের দিতে হবে ৷ ভারতীয় জনতা পার্টি সবসময়ই শিল্পের পক্ষে রয়েছে ।’’
সিঙ্গুরের প্রাক্তন বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য: এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, ট্রাইবুনালের রায় টাটাদের পক্ষে গিয়েছে । এই সমগ্র ব্যাপারে টাটার ভূমিকা ছিল কারখানা গড়ার প্রচেষ্টা । তৃণমূল কংগ্রেস তখন ক্ষমতায় ছিল না । তৃণমূলের আন্দোলন করেছে টাটার বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন হয়েছে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের দমনপীড়ন নীতি এবং জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে । যার বিরুদ্ধেই হোক ফল টাটার বিরুদ্ধেই গিয়েছে ।
এই নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কারখানা ভেঙে দিয়ে টাটা যে ক্ষতিপূরণের দাবি করেছিল, সেটা সঠিক ছিল । বর্তমান সরকার ট্রাইবুনালের রায়ে বর্তমান সরকার চিন্তা করবে টাকা দেবে কি দেবে না । বা অন্য আদালতে যাবে কি না ! সরকারের সঙ্গে এখন আমার যোগাযোগ বা মত বিনিময় হয়নি । টাটাদের দিক থেকে দেখতে গেলে টাটারা সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । তারা কিন্তু দায়ী নয় ।’’
আরও পড়ুন: সিঙ্গুর নিয়ে টাটাকে ক্ষতিপূরণের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি পথে রাজ্য
তিনি এই নিয়ে কাঠগড়ায় তুলেছেন সেই সময়ের বামফ্রন্ট সরকারকে ৷ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, এই ক্ষতির জন্য দায়ী তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার । আর যারা আন্দোলন করেছে, মূলত তারা । এখন তার দায় তৃণমূল সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ছে । আখেরে সিঙ্গুরের কারখানাও হয়নি৷ জমি ফেরত দেওয়া সম্পূর্ণভাবে যায়নি । অধিকাংশ জমি জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে । চাষিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । টাটারাও চলে গিয়েছে ।
তিনি আরও বলেন, ‘‘এটা শুধু সিঙ্গুরের দুর্ভাগ্য নয় । সারা পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য । তারপর থেকে আর কোনও বড় শিল্পপতি বা শিল্প আসেনি এখানে । এটা যারই ভুলে হোক তৃণমূলের আন্দোলন অথবা বামফ্রন্টের চুক্তি প্রত্যাখ্যান এর ফলে টাটাকে চলে যেতে হয়েছিল ।’’
সিঙ্গুর নিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে সিপিএমের বক্তব্য: সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা টাটাদের জয় আর সরকারের পরাজয় সেভাবে আমরা দেখছি না । সরকার একটা চলমান প্রক্রিয়া । সেই সময় সরকার যখন বামফ্রন্ট পরিচালনা করেছে, তখন শিল্পে বিকাশ ঘটানোর জন্য চেষ্টা করেছে । সেই সময় ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এই শিল্পকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে । পরে আদালতের নির্দেশে জমি ফেরত হয়েছে ৷ এমনকি অনিচ্ছুক চাষিদের এখনও ভাতা দেওয়া হচ্ছে ।’’
তাঁর দাবি, সেই সময়ের বামফ্রন্ট সরকার এ রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য বেকার ছেলেমেয়েদের জন্য যে সমাধান সূত্র বার করার চেষ্টা করছিল, সেটা ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করে শেষ করে দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে রাজ্যের শিল্পের শ্মশান আর কর্মসংস্থানের জন্য কোনও সুযোগ নেই । ট্রাইবুনাল যে টাকার ক্ষতি পূরণের কথা বলছে । ফের সেই টাকার ক্ষতিপূরণ জনগণের থেকেই দিতে হবে বর্তমান সরকারকে ।
আরও পড়ুন: ন্যানো ক্ষতিপূরণ! টাটাকে প্রায় 766 কোটি টাকা দিতে হবে মমতা সরকারকে