দার্জিলিং, 18 জুন: দার্জিলিং চা-এ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ ছিল চা নিলামকারীদের মধ্যে ৷ কিন্তু ধীরে ধীরে এই উদ্বেগের অবসান হচ্ছে ৷ কারণ বর্তমানে ভেষজ চাষের দিকে ঝুঁকছে দার্জিলিঙের চা বলয় ৷ পোকামাকড় নির্মূল করতে চা চাষে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ক্রমাগত কমছে ৷ পাহাড় ও তরাই অঞ্চলের চা উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার যতটা সম্ভব কমানোর দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা ৷
অ্যামেরিকা, জার্মানি, জাপান, সুইৎজারল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলিতে দার্জিলিং চায়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে ৷ আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত দার্জিলিং চায়ের প্যাকেজিং এবং দেশ বা বিদেশের বাজারে পাঠানোর আগে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয় ৷ চা গাছ রোপণের সময় পোকামাকড়ের উপদ্রবে নাজেহাল হতে হয় চা চাষিদের ৷ দার্জিলিং ছাড়াও জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুরের কিছু অংশের চা চাষে এই সমস্যার সম্মুখীন হন চাষিরা ৷ এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ভারী বৃষ্টি ৷ পোকার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি ফসলের উন্নতিতেও সাহায্য করে বৃষ্টি ৷
পশ্চিমবঙ্গের চা বাগানে শুঁয়োপোকার উপদ্রব খুব সাধারণ বিষয় ৷ এরপরই রয়েছে সবুজ মাছি ৷ এছাড়াও চা পাতার উপর লালচে ভাব চাষিদের জন্য আরও একটি ভাবনার বিষয় ৷ এই বিষয়ে সুকনা চা বাগানের ম্যানেজার ভাস্কর চক্রবর্তী বলেন, "চায়ের কুঁড়ি, নতুন ও পুরোনো চা পাতায় নানা প্রজাতির পোকামাকড়ের হানা ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ৷ কীটনাশক ব্যবহার নিয়ে ভারতীয় টি বোর্ডের কড়া নির্দেশিকা মেনে এই সমস্যাগুলির সমাধান করা হয় ৷" ভাস্কর চক্রবর্তীর কথায় সম্মতি জানিয়েছেন তরাই অঞ্চলের দাগাপুর চা বাগানের ম্যানেজার সন্দীপ ঘোষ ৷ তাঁর কথায়, "সচেতনতার অভাবে ছোটো ছোটো চা বাগানগুলিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে ৷ যা বড় চা বাগানগুলির ক্ষেত্রে কখনও হয় না ৷ কারণ তারা রাসায়নিক ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ৷ কিন্তু এখন ক্ষুদ্র চা চাষিরাও বুঝে গেছে যে অত্যধিক কীটনাশকের প্রয়োগে বরাত বাতিল হতে পারে ৷"
চা-চাষে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীনে থাকা ভারতীয় টি বোর্ডের অ্যাপেক্স সংস্থার কড়া নির্দেশিকা রয়েছে ৷ প্ল্যান্ট প্রোটেকশন কোড তৈরির জন্য দেশের চা গবেষণা কেন্দ্র, উত্তর-পূর্বের চা গবেষণা সংস্থা ও দক্ষিণ ভারতের UPASI টি রিসার্চ ফাউন্ডেশন মিলে একযোগে তৈরি হয়েছে এই টি বোর্ড ৷ FSSAI (খাদ্য সুরক্ষা ও স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া) এবং PPF দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে এই কোড ৷ যার অনুমোদন দিয়েছে 1968 সালের কীটনাশক আইনের অধীনে গঠিত কেন্দ্রীয় কীটনাশক বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন কমিটি (CIB) ৷ কীটনাশক কতটা মাত্রায় ব্যবহার হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব রয়েছে এই কমিটির উপর ৷
কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে EPA, FAO, WHO, কোডেক্স এবং অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে ভারতীয় টি বোর্ড ৷ কোড তৈরির সময় কীটনাশক ব্যবহার নিয়ে টি পেস্ট ম্যানেজমেন্টের দেওয়া নির্দেশিকা যাতে সঠিকভাবে মেনে চলা হয় তা নিশ্চিত করেছে টি বোর্ড ৷ এই বিষয়ে ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য উপদেষ্টা অমৃতাংশু চক্রবর্তী বলেছেন, "আমরা নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারি না ৷ ছোটো হোক বা বড়, সবরকম চা বাগানের জন্যই অনুমোদনহীন কীটনাশকের প্রয়োগ নিষিদ্ধ ৷" রাজ্যের মধ্যে দার্জিলিংয়ের চা আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত ৷ অ্যামেরিকা, ইউরোপে রপ্তানি করা হয় এই চা ৷ এই বিষয়ে দার্জিলিং টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বিনোদ মোহন বলেছেন, "রাসায়নিক মুক্ত ভেষজ জিনিসের চাহিদা এখন তুঙ্গে ৷ তাই সম্পূর্ণ ভেষজ সারের প্রয়োগে দার্জিলিং চায়ের চাষ করার চেষ্টা হচ্ছে ৷ শীঘ্রই রাসায়নিকের ব্যবহার একেবারে কমিয়ে একশো শতাংশ ভেষজ পদ্ধতিতে চা চাষের চেষ্টা হচ্ছে ৷ এখানকার চা অ্যামেরিকা, জার্মানি, জাপান, ইংল্যান্ডের মতো দেশে রপ্তানি করা হয় ৷ তাই আমাদের তরফে কোনওরকম গাছাড়া ভাব কাম্য নয় ৷"
প্রথম ফ্লাশ, দ্বিতীয় ফ্লাশ, মনসুন ফ্লাশ ও অটম ফ্লাশ- এই চার ভাগে বিভক্ত দার্জিলিঙের চা-চাষ ৷ দার্জিলিং চায়ের ক্ষেত্রে প্রথম ফ্লাশ, দ্বিতীয় ফ্লাশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ৷ এরপর আসে মনসুন ফ্লাশ ও অটাম ফ্লাশ ৷ শীতে চা-বাগানগুলি কেটে সাফ করার আগে উৎপাদন ও প্যাকিংয়ের কাজ সম্পূর্ণ করা হয় ৷ ডুয়ার্সের TAI ইউনিটের সচিব রাম অবতার শর্মা বলেন, "তরাই অঞ্চলে কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে পোকামাকড়ের মোকাবিলা করা হয় ৷ কিন্তু অনুমোদনহীন কীটনাশকের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ ৷ এই বিষয়ে টি বোর্ডের দেওয়া নির্দেশিকা মেনে চলতে হয় ৷"
অ্যাসিফেট, কার্বেন্ডাজ়িম, মনোক্রোটেফস ইত্যাদির মতো কীটনাশকের ব্যবহার করছেন না চা-চাষিরা ৷ বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গোবর, নিমের নির্যাস, সরষের অবশিষ্টাংশ, নিম তেল ইত্যাদি ৷