শিলিগুড়ি, 7 জুন: "আগে সিনেমায়, টিভিতে বা খবরে দেখতাম ট্রেন দুর্ঘটনা কতোটা ভয়াবহ হয় । কোনওদিন ভাবিনি আমার নিজের সঙ্গে হবে ৷ আমার ট্রেনটিই দুর্ঘটনার কবলে পরবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন ট্রেনে কোথাও যেতেও ভয় করবে।" কথাগুলি বলার সময়েও হাত পা কেঁপে উঠছিল শিলিগুড়ির ওই নবশ্রী সাহা চৌধুরী। বলছিলেন, রাতে স্বপ্নের মধ্যেও ভেসে উঠছে বালাসোরে বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে জোড়া ট্রেন দুর্ঘটনার দুর্ঘটনার সেই ভয়াবহতার ছবি। আতঙ্ক ওই যুবতীকে এতোটাই গ্রাস করেছে যে কোনওভাবেই ওই অভিশপ্ত দিনের কথা মনে করতে চাইছেন না তিনি । টানা দু'দিন কারোর সঙ্গে সেভাবে কথাও বলেননি। মৃত্যু উপত্যকার সেই নারকীয় ছবি চাক্ষুষ করার পর থেকে এখনও বিষণ্ণ শিলিগুড়ির চয়মপাড়ার বাসিন্দা 21 বছরের।
বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি সংস্থার নার্সিংয়ের কোর্স শেষ করার পর তার সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিলেন নবশ্রী । আর ফেরার পথে যে এমন দুর্ঘটনার সঙ্গী হতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি । সার্টিফিকেট নিয়ে যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসে একাই ফিরছিলেন নবশ্রী। কিন্তু বালাসোরের কাছে করমণ্ডলের সঙ্গে দুর্ঘটনার কবলে পরে তাঁর ট্রেন । তিনি যে কামরায় ছিলেন সেটি লাইনচ্যুত হয়ে উলটে যায় । প্রচণ্ড ধাক্কার অভিঘাতে রেললাইন ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল কামরার ভিতর । ভেঙেচুরে, দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল গোটা কামরা । লাইনচ্যুত হওয়ার পর তাঁর কামরাটি বেশ কিছুটা দূরে ডিগবাজি খেতে খেতে গিয়ে থামে । এমনই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন নবশ্রী ৷
আরও পড়ুন: 'চোখের সামনে বন্ধু চলে গেল, আর বাইরে কাজে যাব না !' নাগরাকাটার পরিযায়ী শ্রমিকের আর্তনাদ
বেঙ্গালুরু থেকে বিমানে আসার কথা ছিল তাঁর । কিন্তু বিমানের টিকিট বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাঁকে যশবন্তপুর হাওড়া এক্সপ্রেসের টিকিট কাটতে হয় । সেই ট্রেনে করেই বাড়ি ফিরছিলেন তিনি । হাওড়ায় অপেক্ষা করছিলেন বাবা । দুর্ঘটনার মুহূর্তে ট্রেনে জানালার পাশে বসে মোবাইল চার্জ দিচ্ছিলেন নবশ্রী । বালাসোরের কাছে এসে আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনের কামরা উলটে যায় । তীব্র আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করেও কোনওমতে হাতের কাছের ব্যাগটা বের করে ট্রেনের কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি । স্থানীয় লোকেদের সহায়তায় এক্সপ্রেস হাইওয়ে হয়ে বাবুঘাটে চলে আসেন নবশ্রী । তারপর সেখান থেকে বাড়ি ফেরেন তিনি ।
নবশ্রী বলেন, "ট্রেন প্রথমে চার ঘণ্টা দেরিতে চলছিল । আর সেই কারণেই ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটছিল বুঝতে পারছিলাম । আমি জানালার পাশে মোবাইল চার্জ দিচ্ছিলাম । পাশে রেড সিগনালও দেখতে পেয়েছিলাম ৷ কিন্তু ট্রেনটি এত জোরে চলছিল যে কোন কিছু বোঝার আগেই আমাদের কামরাটি উলটে যায় । আমাদের পেছনের কামরাটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল । সেখানে আগুন জ্বলছিল । চারিদিকে চিৎকার আর চিৎকার ।"
আরও পড়ুন: 'রক্তাক্ত দেহের উপর পা রেখে জানলা দিয়ে বেরিয়ে প্রাণে বেঁচেছি'
তিনি আরও বলেন, "যখন বাইরে বের হই তখনও জানি না যে এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে । আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমাদের ট্রেনটাই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে । পরে শুনতে পাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস ও আরও একটি মালগাড়ি একই জায়গায় দুর্ঘটনার কবলে । এতো ভয়াবহ সেই দৃশ্য যা বর্ণনা করা কঠিন ।" নবশ্রী জানান, টাকা পয়সা, আরও ব্যাগ সব হারিয়ে গিয়েছিল । আঘাত ছিল, ব্যাথাও করছিল । কিন্তু তার তখন মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল । যে করেই হোক তাঁকে বাবার কাছে ফিরতেই হবে ।