দার্জিলিং, 23 মে : তখন দুপুর 2টো । কাঞ্চনজঙ্ঘার কোল বেয়ে ফুটে উঠেছে রোদ্দুর । কয়েকজন তৃণমূল কর্মী তখনও গণনাকেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন । অমর সিং রাই হারছেন । আভাস পেয়েও তাঁরা ফিরে আসেননি । আসলে, মমতার বক্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিলেন আর কী ! দিদি যে বলেছেন, "গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র ছেড়ে চলে আসবে না ।" ঠিক এক ঘণ্টা পর নামল বৃষ্টি । হালকাই । মাথায় ছাতা নিয়ে তখন BJP কর্মীরা ভিড় করেছেন গণনাকেন্দ্রের বাইরে । আছেন গুরুংপন্থী গোর্খার সমর্থকরা । এক রাউন্ড করে গণনা হচ্ছে, আর বাড়ছে মোদি মোদি চিৎকার । বিস্তার মুখেও ফুটছে হাসি । কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামল । মেঘলা আকাশ তখন রোদের আভা কেড়েছে । মুখ গোমড়া তৃণমূল কর্মীদেরও । পাহাড় তাদের জন্য হাসছে কই ?
এই সংক্রান্ত আরও খবর : দেশজুড়ে রং দে গেরুয়া
2011-তে ক্ষমতায় আসার পরই গোর্খাল্যান্ড ইশুর সমাধান করতে উঠে-পড়ে নামেন মমতা । গুরুংয়ের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে পাহাড়কে অনেকটাই শান্ত করে তোলেন । গুরুংও এক সভা থেকে মমতাকে "মা" বলে সম্বোধন করেন । বন্ধুত্বের সেই শুরু । দিন গেছে, বন্ধুত্ব বেড়েছে । আর মাঝেমধ্যেই পাহাড়ে গিয়ে মমতা বলে এসেছেন, "পাহাড় হাসছে ।" হঠাৎ ছন্দপতন । গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে গুরুংয়ের উলটপূরণে সমস্যায় পড়েন মমতা । 2014-তে BJP-র কাছে আসনও খোয়াতে হয় । এরপর 2016 । তখনও পাহাড়বাসীর রাগ কমাতে পারেননি । 3 বিধায়কই পায় মোর্চা । জাতিভিত্তিক আন্দোলন বাড়তে থাকে । উত্তপ্ত করে তোলে পাহাড়ের পরিস্থিতি । 100 দিন যাবৎ অশান্তির আগুনে জ্বলছিল দার্জিলিং । তাও আবার মমতার সফরের পরেরদিন থেকেই । পরে পরিস্থিতি সামলাতে দুঁদে গোয়েন্দাদের পাঠান মুখ্যমন্ত্রী । শেষমেশ শান্তি মেলে । পাহাড় অবশ্য হাসেনি ।
এই সংক্রান্ত আরও খবর : পরাজয় মানেই পরাজিত নয় : মমতা
আত্মগোপন করতে বাধ্য হন গুরুং । বিনয় তামাংকে তাঁর জায়গায় আনা হয় । বেশ ভালোই দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন বিনয় । গুরুংকেও 'সরিয়ে' দেওয়া গেছিল । একাধিক বোর্ডের উদ্বোধন, উন্নয়ন প্রকল্প পাহাড়বাসীকে ফের মমতার কাছে এনে দেয় । বিভিন্ন জনসভা থেকে স্লোগান তোলেন, "পাহাড় হাসছে ।" লোকসভা নির্বাচনের সময়তেও পাহাড়বাসীর মন রাখতে ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করেন মমতা । আশা করেছিলেন অমর সিং রাইয়ের সমর্থনে গোর্খা আবার এক হবে । হল আর কোথায় ? BJP হালকা চালে বাজিমাত করে গেল যে । রাজু বিস্তা ভূমিপুত্র না হলেও বয়সে তরুণ । সাথে পেলেন গোর্খা (বিমলপন্থী)র সমর্থন । গুরুং অন্তরালে থেকেও বুঝিয়ে গেলেন, পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে । জিতিয়ে ফেরালেন রাজুকে । বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই পাহাড়ের "সর্বেসর্বা" ।
এই সংক্রান্ত আরও খবর : 2009-এর পুনরাবৃত্তি ?
শুধু পাহাড় নয়, মমতার থেকে মুখ ফিরিয়েছে উত্তরবঙ্গের সবকটি কেন্দ্র । আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, বালুরঘাট । কোনও কেন্দ্রেই দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূল । এরমধ্যে একমাত্র মালদা দক্ষিণে ডালুমিঞা (কংগ্রেস) কোনওরকমে আসন টিকিয়ে রেখেছেন । বাকি সাত আসনই গেছে BJP-র দখলে । আলিপুরদুয়ারে জয় পেয়েছেন জন বারলা । জলপাইগুড়িতে জয়ন্তকুমার রায়, রায়গঞ্জে দেবশ্রী চৌধুরি, মালদা উত্তর খগেন মুর্মু, বালুরঘাটে সুকান্ত মজুমদার ।
কেন এরকম ফল ?
দার্জিলিঙের জয়ী প্রার্থী রাজু বিস্তা বলছেন, "পাহাড়ে তো আমরা জিতব জানতামই । গায়ের জোরে পুলিশ প্রশাসনকে সামনে রেখে অত্যাচার চালিয়েছে রাজ্য সরকার । মুখ খুললেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে । সামান্যতম সমালোচনাকেও রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিত ওরা । মানুষ এর থেকে মুক্তি চাইছিল । মুক্তিও মিলেছে ।"
পাহাড়ে না হয় গোর্খাল্যান্ড ইশু ঘৃতাহুতি দিয়েছিল । আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে সমস্যা কী ? তৃণমূল নেতা সৌরভ চক্রবর্তী বলছেন, "আমরা হতবাক । এরকম হওয়ার কথা নয় । BJP হিন্দুত্বের তাস খেলেছে । উন্নয়নকে সরিয়ে মেরুকরণের রাজনীতিই সাফল্য পেয়েছে ।" কোচবিহারের তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলছেন, "এত পদ্ম আমরা কল্পনা করিনি ।"
এই সংক্রান্ত আরও খবর : দেশের কাছে সৎ থাকব, জেনেশুনে ভুল করব না : মোদি
গণনাকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে এক গোর্খা সমর্থক (বিমলপন্থী) বলছিলেন, "মমতা বলতেন পাহাড় হাসছে । জোড়াফুল ফোটানোর চেষ্টা করেও উনি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি । এবার হাসি ফুটবে । পাহাড়ে হাসি ফোটাব আমরাই ।"
এই সংক্রান্ত আরও খবর : বাংলায় পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে : দিলীপ
কথা বলতে বলতেই কানে এল, রাজু বিস্তা এগিয়ে আছেন প্রায় 2 লাখ ভোটে । তখন বিকেল 4টে । কাঞ্চনজঙ্ঘার কোণ দিয়ে হঠাৎ যেন আলোর বিচ্ছুরণ । ফের একবার আকাশ জুড়িয়ে এল সূর্য । আলোর ছটায় চিকচিক করে উঠল BJP কর্মীদের মুখ । সাথে মোদি-মোদি রব । তৃণমূল শিবিরে তখন শুধুই অন্ধকার ।