কলকাতা, 21 সেপ্টেম্বর : বরকত গনিখান চৌধুরী, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, তপন শিকদার ও সুকান্ত মজুমদারের মধ্যে মিল কোথায় ? রাজনৈতিক কুইজে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, এরা সকলেই উত্তরবঙ্গের মানুষ এবং এরা নিজের রাজনৈতিক দলের রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। মঙ্গলবার বিজেপির রাজ্য দফতরে নবনিযুক্ত সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দায়িত্ব নিয়েছেন। দিলীপ ঘোষের ছেড়ে যাওয়ায় জুতোয় পা-গলিয়ে এই রাজ্যে বিজেপিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে ৷
প্রয়াত তপন শিকদারের জন্মদিনের রাতেই ‘উত্তুরে’ হাওয়া লেগেছিল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের সদর দফতরে। এই লেখা রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতির গুণকীর্তন করতে নয়। বরং বলা ভাল, রাজ্য রাজনীতিতে উত্তরবঙ্গের ওজন মাপার চেষ্টা। বঙ্গীয় রাজনীতিতে উত্তরবঙ্গ উপেক্ষিত। রাজ্য রাজনীতির নেতৃত্বের পরিসংখ্যানে চোখ বোলালে মনে হতেই পারে, কলকাতা কেন্দ্রীক শাসকের কাছে উত্তরবঙ্গ ব্রিটিশ আমলের আন্দামান। বেগড়বাই করলেই শাস্তিস্বরূপ উত্তরবঙ্গে বদলি করে দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষাপটে সরাসরি উত্তর থেকে জাতীয় দলের রাজ্য শাখার সভাপতি এই প্রথম। পেশায় অধ্যাপক, বটানিতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী বালুরঘাটের সাংসদের বয়স চল্লিশের কোটায়। সেদিক থেকে তাজা রক্ত। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি ও তপন শিকদারকে কলকাতা কেন্দ্রীক রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছিল ৷ দু'বারের বিধায়ক অরুণ মৈত্র প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হলেও তাঁকে মনে রেখেছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা বিধানভবনেই কম।
সুকান্ত মজুমদারের রাজ্য বিজেপির প্রধান হওয়া প্রসঙ্গে শিলিগুড়ি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ ইটিভি ভারত-কে বলেন, "উত্তরবঙ্গ থেকে রাজ্য সভাপতি হওয়ায় গর্বিত ৷ তবে বিজেপি কোনও আঞ্চলিক দল নয়, আমরা সর্বভারতীয় দল হিসেবে দেশের সর্বস্তরে পৌঁছতে চাই ৷ আমাদের লক্ষ্য হল দেশের সার্বিক উন্নয়ন ৷"
যদিও এমনটা মনে করেন না তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় ৷ ইটিভি ভারতকে ফোনে সুব্রত বলেন, "আমার মনে হয় না উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা উপেক্ষিত ৷ তবে ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনৈতিক ও প্রসাশনিক কারণে উত্তরবঙ্গ পিছিয়ে ছিল ৷ এখন অনেকটা উন্নত হলেও রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে এমনটা বলা অর্থহীন ৷ কারণ দক্ষিণবঙ্গ কলকাতার কাছাকাছি হওয়ায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটু বেশি বলা যেতেই পারে ৷"
আরও পড়ুন: বুদ্ধিজীবীদের তোপ বিজেপির নয়া রাজ্য সভাপতি সুকান্তর, পাশে থাকার আশ্বাস দিলীপের
ডানপন্থী রাজনীতিতে ‘উত্তরায়ন’ দেখা গেলেও বামপন্থী রাজনীতিতে তার অভাব রয়েছে ৷ একসময় উত্তরবঙ্গের মাটিতে বামপন্থী আন্দোলন প্রসারিত হলেও সিপিআই বা সিপিএমের উচ্চপর্যায়ের উত্তরবঙ্গের নেতারা সেভাবে জায়গা পাননি ৷ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনন্দ পাঠক বা অশোক ভট্টাচার্যের কথা মাথায় রেখেও এই কথা বলা যায়। অশোক ভট্টাচার্যকে সম্পাদকমণ্ডলীতে জায়গা পেতে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে ৷ ক্ষিতি গোস্বামী এবং কমল গুহর নামও একই বন্ধনীতে রাখতে হবে। অনেকেই বলবেন চারু মজুমদার, কানু স্যানালের কথা। অতিবাম রাজনীতির কথা বলতে গেলে চারু মজুমদারের কথা আসবেই। জীবিতকালে তিনি যতটা প্রভাব ফেলেছিলেন মৃত্যুর পরে তার প্রভাব বেশি। আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন প্রয়াত চারু মজুমদার। সেদিক থেকে কানু স্যানালের উত্তরণ কম।
সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংষ্কৃতিক ক্ষেত্রের মত বাংলার রাজনীতি কলকাতা তথা দক্ষিণবঙ্গ কেন্দ্রীক। উত্তরবঙ্গ উপেক্ষিত। উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণের জ্যোতি বসু এবং উত্তরের রতনলাল ব্রাহ্মণের উত্তরণের গ্রাফের দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে। সমসাময়িক হলেও দু"জনের সামাজিক প্রভাব আসমান জমিন ফারাক। সেদিক থেকে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নিয়ে জিএনএলএফ সভাপতি সুবাস ঘিসিংকে মনে রাখতেই হবে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি এবং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে কার্যত দৌড় করিয়েছিলেন তিনি। আঞ্চলিক দল হয়েও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গোর্খা সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি ৷ সহিংস আন্দোলনের জেরে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছিল। এখন পাহাড়ের নেতাদের ভাষণ বেশি রেশন কম ৷ পাশাপাশি পাহাড়ের রাজনীতি এখন পদ্মময়।
আরও পড়ুন : পদ্মফুল, পেন ও মালা দিয়ে সুকান্তকে সংবর্ধনা দিলীপের
দিলীপ ঘোষের হাত থেকে ব্যাটন নেওয়ার দিনে আসন্ন উপনির্বাচন থেকে পুরনির্বাচনে দলকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন নবনিযুক্ত বিজেপির রাজ্য সভাপতি। দিলীপ ঘোষের মতো তিনিও আরএসএস-এর স্বয়ংসেবক। তবে দিলীপ ঘোষ তাঁর নেতৃত্বকালে বিরোধিতার সুর চড়ায় বেঁধেছিলেন ৷ শব্দচয়ন থেকে প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ সবেতেই দিলীপবাবু ছিলেন টপ গিয়ারে। এই আবহে বটানি অধ্যাপকের স্ট্যান্স কী হয়, তা দেখার। বিজেপিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলে উন্নীত করেছেন দিলীপবাবু ৷ পরের ধাপে দলকে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ সুকান্ত মজুমদারের সামনে। পুর নির্বাচন সেই চ্যালেঞ্জের সেমিফাইনাল। কারণ অগ্নিকন্যাকে সামাল দিতে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিতে হবে। বাম ও কংগ্রেসের কথা মাথায় রেখেও বলতে হয় এই রাজ্যের বিরোধী রাজনীতির স্টিয়ারিং এখন উত্তরবঙ্গের মাস্টারমশাইয়ের হাতে। যদি তিনি সফল হন, তাহলে রাজ্য রাজনীতিতে 'দাগ' কাটতে পারবেন ৷ না-হলে ব্রাত্য উত্তরবঙ্গের নেতাদের তালিকায় আরও একটি নাম যোগ হবে মাত্র।