ফলতা, 28 ফেব্রুয়ারি: জন্ম থেকেই তার দুই হাত প্রায় অসাড় । দু'টো চোখেই ভালো করে দেখতে পায় না সে । মেয়েকে নিয়ে উদ্বেগের শেষ ছিল না পরিবারের । সেই মেয়ের অদম্য জেদের কাছে হার মানল পরিস্থিতি ৷ যা কোনওদিন ভাবতে পারেননি পরিবারের লোকজন, তাই করে দেখাল মেয়েটি । এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় (Madhyamik Exam 2023) বসল সে । দক্ষিণ 24 পরগনার ফলতার শতলকলসা হাইস্কুল পরীক্ষাকেন্দ্রে রাইটার নিয়েই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে বিশেষভাবে সক্ষম লাবণী রায় । ফলতার বেলসিংহ গ্রাম পঞ্চায়েতের সোনাকোপা গ্রামের বাসিন্দা সে।
চানাচুর কারখানার কর্মী আনন্দ রায় ও ইরাবতীর দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে লাবণীই ছোট । কিন্তু জন্ম থেকেই মেয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা চিন্তায় ফেলে দেয় রায় দম্পতিকে । একদিকে সাংসারিক অনটন অন্যদিকে মেয়েকে নিয়ে দু:শ্চিন্তা ক্রমে গ্রাস করে তাঁদের । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এক অদম্য জেদ যেন পেয়ে বসে লাবণীকে । উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে চায় সে । বর্তমানে স্থানীয় বেলসিংহ গার্লস হাইস্কুলের মাধ্যমিকের ছাত্রী লাবণী।
বৃহস্পতিবার থেকে মা ইরাবতী রায়ের সঙ্গে শতলকলসা হাইস্কুল পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসছে সে হাসিমুখেই । নিজের স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী রাকিবা খাতুনকে রাইটার হিসেবে নিয়ে পরীক্ষা দেয় লাবণী । পরীক্ষা দিয়ে লাবণী জানায়, পরীক্ষা বেশ ভালোই হচ্ছে তার । বাকি পরীক্ষাগুলিও ভালো হবে বলেও নিশ্চিত সে । আগামিদিনে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায় লাবণী । বেলসিংহা গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা জানান, পঞ্চম শ্রেণি থেকেই ওই স্কুলে পড়াশোনা করছে লাবণী রায় । পরীক্ষার আগে পরিবারের লোকজন স্কুলে জানায় লাবণী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চায় ৷ কিন্তু তার দুটি হাত কাজ না-করায় কীভাবে সে পরীক্ষা দেবে ? তা নিয়েই ভাবনায় পড়ে যায় সবাই ৷
শেষমেশ তার জন্য একজন রাইটার নির্বাচন করে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে আবেদন করা হয় । সেই মতোই লাবণী পরীক্ষা দিচ্ছে ৷ বিশেষভাবে সক্ষম মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর খবর পেয়ে ফলতা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর খান সমিতির শিক্ষার কর্মাধ্যক্ষকে নির্দেশ দেন ওই ছাত্রীর যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য ৷ সেই মত প্রথম দিন ফলতা পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষার কর্মাধ্যক্ষ নিজের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেন লাবণী রায়কে ৷ তারপর পরীক্ষার বাকি দিনগুলিতে ওই ছাত্রীর যাতায়াতের জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় ।
ফলতার বিডিও সন্দীপ ঘোষ জানিয়েছেন, লাবণীর স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে তার রাইটার হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে । মধ্যশিক্ষা পর্ষদ তা অনুমোদন করায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ওই পরীক্ষার্থী এবার মাধ্যমিকে বসেছে । এদিন পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে ওই পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথাও হয়েছে তাঁর । সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরে তার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে । লাবণীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করে তার স্বপ্নপূরণের আশীর্বাদ করেন বিডিও ।
লাবণীর জীবনযুদ্ধকে কুর্নিশ জানিয়েছেন ডায়মন্ডহারবারের মহকুমাশাসক অঞ্জন ঘোষও । তার উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করেন তিনি । লাবণী পরিবারের লোকজনকে জানায়, আগামিদিনে আরও পড়াশোনা করতে চায় সে । আর এ নিয়ে বিপাকে পরিবারের লোকজন । দিনমজুর পরিবারে কোনোক্রমে চলে সংসার ৷ তার মাঝে কীভাবে লাবণী রায়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরিবার। অবশ্য ব্লক প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, লাবণী যদি আরও পড়াশুনা করতে চায়, তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবরকম সাহায্য করা হবে ।
আরও পড়ুন: মাথায় ইট পড়ে আহত, হাসপাতালে বসে ভূগোল পরীক্ষা দিল এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী