সুন্দরবন (দক্ষিণ 24 পরগনা), 25 মে : আয়লা, ফণি, বুলবুল একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের জেরে বাঁধ ভেঙেছে সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে ৷ নোনাজল ঢুকে নষ্ট হয়েছে চাষের জমি ৷ ভিটেমাটি হারিয়েছেন সুন্দরবন ও সাগরের বহু মানুষ ৷ শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ভরা কটালেও একাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙে ভেসে গিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম ৷ গত দশ বছরে সুন্দরবন এবং সাগরের মানুষজনদের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷
চলতি মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র কোনও প্রভাব না পড়লেও, সুন্দরবনের বাঁধের দুরবস্থার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ৷ ফলে আতঙ্ক কাটছে না মানুষের ৷ এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের উপকূলবর্তী এলাকায় স্থায়ী নদীবাঁধের দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা ৷ সুন্দরবন নদীবাঁধ ও জীবন-জীবিকা রক্ষা কমিটি বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থায়ী বাঁধের দাবিতে আন্দোলন করছে ৷ মঙ্গলবার সেই দাবি নিয়ে কমিটির তরফে রাজ্যের সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রকে একটি স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয় (Memorandum to Irrigation Minister Demanding Repair of River Embankment in Sundarbans) ৷ সেই সঙ্গে গোসাবা, বাসন্তী, পাথরপ্রতিমা ও সাগর এলাকায় কমিটির সদস্যরা নদীবাঁধের উপর অবস্থান বিক্ষোভ করেন ৷
2009 সালে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আয়লায় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় 1400 কিলোমিটার নদীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৷ এর মধ্যে 778 কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ তৎকালীন বাম সরকার কেন্দ্রের দ্বারস্থ হলে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে 5032 কোটি টাকা মঞ্জুর হয় কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করতে ৷ রাজ্যের তরফে 6 হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছে চাওয়া হয়েছিল ৷ আর বাঁধ তৈরিতে রাজ্য সরকারও 10 শতাংশ টাকা দেবে বলে কেন্দ্রকে জানিয়েছিল ৷ কিন্তু, কেন্দ্র সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় ৷ পাল্টা রাজ্য সরকারকে 25 শতাংশ টাকা দিতে বলে ৷ সুন্দরবনবাসীর কথা মাথায় রেখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রস্তাব মেনে নেন ৷
পরবর্তী আরও দু’টি পর্যায়ে মোট 1400 কোটি টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেয় কেন্দ্রীয় সরকার ৷ শর্ত দেওয়া হয়, তিন বছরের মধ্যে বাঁধ তৈরি করতে হবে ৷ এর জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ৷ সেই টাস্ক ফোর্সে কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, রাজ্যের বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, সুন্দরবন বিশারদ তুষার কাঞ্জিলালের মতো মানুষজনকে রেখে কংক্রিটের বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় ৷ প্রাথমিকভাবে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছিল রাজ্য সরকার ৷ এর পর কেন্দ্রের টাকা আসতেই বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় ৷
আরও পড়ুন : River Dam Repair : উদাসীন প্রশাসন, জমি বাঁচাতে নদীবাঁধ সারাচ্ছেন বাসিন্দারাই
তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার মাত্র 184 কোটি টাকার কাজ করতে পেরেছিল ৷ কারণ, 2011 সালে রাজ্যে পালাবদলের জেরে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল ৷ নতুন সরকারও সুন্দরবনের এই নদীবাঁধ তৈরিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল ৷ বাঁধ তৈরি করতে তৃণমূলের সরকারও জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে ৷ বাঁধ নির্মাণের জন্য জমি দিলে পরিবার পিছু একজনকে চাকরি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
কিন্তু, মাত্র দু’বছরের মধ্যেই সব উদ্যোগ হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে ৷ দুই 24 পরগনায় সুন্দরবন ও সাগরের নদীবাঁধ তৈরির কাজ গতি হারায় বলে অভিযোগ ৷ প্রায় 1 হাজার কোটি টাকার মতো কাজ হয়েছিল দুই 24 পরগনা মিলিয়ে ৷ যেখানে প্রায় 90 কিলোমিটারের কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হয়েছিল ৷ কিন্তু, কোন অজ্ঞাত কারণে সেই কাজ থেমে যায় ? তার উত্তর পাওয়া যায়নি ৷ এর পর ফণি, বুলবুল এবং সবশেষে আমফানের দাপটে বারবার বাঁধ ভেঙেছে সুন্দরবনের উপকূলে ৷ ভেসে গিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম ৷ বহু চাষের জমি নোনা জলের তলায় চলে গিয়েছে ৷ সেচ দফতরের তরফে প্রতিবার অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করা হলেও, প্রতিবছর কোনও না কোনও ঝড়ে বাঁধ ভেঙে গিয়েছে ৷
অন্যদিকে, কংক্রিটের বাঁধ তৈরির কাজ শুরু না হওয়ায়, বছর চারেক আগে কেন্দ্র প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয় ৷ রাজ্যের প্রাক্তন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্কর বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার সুন্দরবনের স্থায়ী বাঁধ তৈরিতে যথেষ্ট উদাসীন ৷ সেই কারণেই এতগুলি টাকা ফেরত চলে গিয়েছে ৷ এই সরকারই সুন্দরবনের মানুষকে জলে ফেলে দিল ৷’’