সুন্দরবন, 29 মে : জলস্তর কিছুটা কমতেই ত্রাণশিবির থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন সুন্দরবনের মানুষ ৷ তবে ফিরে তাঁরা যা দেখলেন, তারপর আর চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি ৷ ঝড় আর কোটালে ধুলিসাত্ হয়ে গিয়েছে বাড়িঘর ৷ নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে গবাদি পশু ৷ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে ভিটে মাটি হারা মানুষজন ৷
মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ঘূর্ণিঝড় যশের আতঙ্কে রাতের ঘুম উড়েছিল সুন্দরবনের উপকূল তীরবর্তী এলাকার মানুষজনের । বুধবার সকালে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে যশ আছড়ে পড়লেও বড়সড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল সুন্দরবন । তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগে ফিরল ভয়ানক কোটালের জলস্ফীতি র আতঙ্ক ৷ সঙ্গে দোসর ঝোড়ো হাওয়া । চোখের সামনে নদীর বাঁধ উপচে জলোচ্ছ্বাস ।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সুন্দরবনের শান্ত নদীগুলি যেন রুদ্র রূপ ধারণ করে ধেয়ে এল গ্রামের দিকে । সুন্দরবনের একাধিক জায়গায় নদীর বাঁধ ভেঙে কয়েক মুহূর্তে বিপুল জলরাশি গ্রামে ঢুকে পড়ে ৷ চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যায় সাধের বাগান, জমির ফসল ৷ তছনছ হয়ে যায় বাড়িঘর ৷ খড়কুটোর মতো মাটির বাড়িগুলি জলের তোড়ে ভেসে যেতে থাকে । তড়িঘড়ি প্রশাসনের আধিকারিকরা ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষদের ত্রাণ শিবিরে সরিয়ে নিয়ে আসেন।
নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গোটা এলাকা । কোটালের জোয়ারের জলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ 24 পরগনার গঙ্গাসাগর, ঘোড়ামারা দ্বীপ, মৌসুনি দ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা-সহ ফ্রেজারগঞ্জ, গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘির বেশ কয়েকটি নদী তীরবর্তী গ্রাম । বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নদীর জলস্তর কমলে ত্রাণ শিবির থেকে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু দেখতে ছুটে যান বহু মানুষ । তবে বাড়ির ভগ্নাবশেষ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই ।
আরও পড়ুন: 15 মিনিটের সাক্ষাতে ক্ষতির রিপোর্ট পেশ মমতার, বাংলা টুইটে সাহায্যের আশ্বাস মোদির
নামখানার পাতিবুনিয়া গ্রামে ছোট্ট পরিবার রাধারানি দাসের স্বামী মৎস্যজীবী ৷ দু বেলা দু মুঠো খাবারের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম চালাতে হয় । লকডাউনের জেরে কর্মহীন স্বামী । কার্যত সংসার চালানো দায় হয়ে গিয়েছে । ঘূর্ণিঝড় যশে সতর্কবার্তা জারি করেছিল প্রশাসন ৷ তাই স্থানীয় একটি স্কুলে ত্রাণশিবির খোলা হয়েছিল প্রশাসনের তরফ ৷ ঝড়ের আগে থেকেই সেখানে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিল ওই পরিবার । প্রতিবেশীদের মুখে গল্প শুনছিল যে, নদীর বাঁধ ভেঙে একের পর এক গ্রামগুলিতে জল ঢুকেছে । তখন থেকেই নিজের বাড়ির ও গবাদি পশুর কথা চিন্তা করে আতঙ্ক দানা বেঁধেছিল । বৃহস্পতিবার বিকেলে জলস্তর একটু কমতে বাড়িতে ছুটে যান তাঁরা । বাড়ির অবস্থা দেখে দু চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি ।
বাড়ি বলতে আর কিছু নেই ৷ রয়েছে কয়েকটা টালি আর অবশিষ্ট কিছু মাটির দেওয়ালের অংশ । গবাদি পশু মারা গিয়েছে । সর্বহারা হয়ে এখন পথেই বসে রাধারানি । নদী ও সমুদ্রের তাণ্ডবলীলায় গ্রামগুলি প্রায় ছোট ছোট নদীতে পরিণত হয়েছে । মাটির বাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে ৷ কিছু-কিছু বাড়িতে প্রায় কোমরসমান জল । মানুষজন সেই জল পেরিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁদের প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও জিনিসের খোঁজ চালাচ্ছেন ৷ তবে বেশিরভাগেরই হদিশ নেই ৷ সুন্দরবনের বানভাসি পরিবারগুলি এখন সরকারি সাহায্যের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ! জীবনে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই এখন সুন্দরবনবাসীর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ।