কোচবিহার, 2 অক্টোবর : স্বপ্নাদেশ পেয়ে ৫০০ বছর আগে কোচবিহারের রাজারা যে পুজো শুরু করেছিলেন, রাজা না থাকলেও নিয়মনীতি মেনে আজও সেই পুজো হচ্ছে । রাজ্য সরকারের পর্যটন দফতরের অধীনে কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজ আমলে শুরু হওয়া ৫০০ বছরের পুরানো বড়দেবীর পুজো নিয়ম ও নিষ্ঠা সহকারে হয়ে আসছে কোচবিহারে । সামনেই পুজো, তাই কোচবিহারের দেবীবাড়ি মন্দিরে বড়দেবীর পুজো নিয়ে জোর কদমে চলছে প্রস্তুতি ৷
কথিত আছে, কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসিংহ শৈশবে তাঁর তিন ভাই শিষ্য সিংহ, কুমার চন্দন ও কুমার মদন-সহ খেলার সঙ্গীদের নিয়ে অসমের চিকনা নামক গভীর জঙ্গলে দেবী দুর্গার পুজো করছিলেন । সেই সময় তাঁর ভাই শিষ্য সিংহ তাঁদের খেলার এক সঙ্গীকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখেন এবং মহারাজা বিশ্বসিংহ কুশ দিয়ে আঘাত করা মাত্রই অলৌকিক ক্ষমতায় সেই বন্ধুর মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে যায় । সেই সময় দেবী দুর্গার আশীর্বাদে বিশ্বসিংহ চিকনার অধিপতি তুরকা কোতয়ালকে পরাজিত ও নিহত করে কোচবিহারের সিংহাসনে আসীন হন । তখন ময়না গাছের ডালকে দেবী দুর্গা রূপে কল্পনা করে পুজো করা হয়েছিল বলে আজও শ্রাবণ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে ময়না গাছের ডাল পুজো করে সেই ময়না কাঠেই দেবীপ্রতিমা গড়া হয় ।
আরও পড়ুন : Durga Puja Special : ইন্দো-বাংলা সীমান্তে জমিদারবাড়িতে একইসঙ্গে পুজো হয় সোনা ও মাটির দুর্গার
পরবর্তীতে কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ (১৫৫৪-১৫৮৭) স্বপ্নাদেশ পেয়ে দশভূজা দুর্গা মূর্তির পুজো শুরু করেন । ইতিহাসবিদদের মতে, মহারাজা নরনারায়ণের ভাই তথা সেনাপতি চিলারায় নিজের বীরত্বে গর্বিত হয়ে কোচবিহারের সিংহাসনে বসার লোভে মহারাজা নরনারায়ণকে হত্যা করতে রাজসভায় গিয়েছিলেন । কিন্তু, রাজসভায় উপস্থিত হতেই চিলারায় দেখতে পান স্বয়ং ভগবতী দুর্গা দশহাত দিয়ে ঘিরে নরনারায়ণকে রক্ষা করছেন । এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে চিলারায় ভয় ও লজ্জায় দাদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন । কিন্তু এই ঘটনায় মহারাজা নরনারায়ণের মনে ভিন্ন ভাবের সৃষ্টি হয় । তিনি ভাবেন, দেবী ভগবতী ভাইকে দর্শন দিল, অথচ তিনি তাঁর দেখা পেলেন না । এরপরই দেবী ভগবতী মহারাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন । এরপর থেকেই প্রতিমা গড়ে এই পুজোর কাজ শুরু হয় ।
দেবী এখানে রক্তবর্ণা । অসুরের গায়ের রং সবুজ । ডানদিকে থাকে সিংহ, বামদিকে চিতাবাঘ । দু'পাশে থাকে জয়া ও বিজয়া । গবেষকদের মতে, মহারাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজোর শুরু করেছিলেন । শরৎকালে গোটা বাংলা যখন দেবী দুর্গার আরাধনায় মেতে ওঠে, তখন কোচবিহারে বড়দেবীর পুজো হয় । বংশপরম্পরায় এই দেবী প্রতিমা তৈরি করে আসছেন চিত্রকর পরিবার । বর্তমানে প্রতিমা তৈরির দায়িত্বে রয়েছে প্রভাত চিত্রকর । তিনি জানিয়েছেন, দেবী দুর্গার চেয়ে এই মূর্তি আলাদা । মূর্তি তৈরিতে চামটা গ্রামের চামটা দেবীর পুজো করে বড়দেবী তৈরির জন্য মাটি নিয়ে আসা হয় । রাজা নেই । তবে প্রথা অনুযায়ী এখনো শ্রাবণ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে গুঞ্জবাড়ি ডাঙরাই মন্দিরে ময়না গাছের ডাল কেটে এনে পুজো করা হয় । এরপর ওই রাতেই শোভাযাত্রা সহকারে ওই ডাল নিয়ে আসা হয় কোচবিহার মদনমোহন বাড়িতে । সেখানে একমাস পুজো হওয়ার পর সেই ময়নাকাঠ নিয়ে যাওয়া হয় দেবীবাড়ি মন্দিরে । সেখানে বিশেষ পুজোর পর সেই ময়নাকাঠেই তৈরি হয় বড়দেবী । এই দু‘মাস ধরে প্রতিদিন চলে দেবীর পুজো ৷