অতি দীর্ঘ এক নির্বাচন প্রক্রিয়া আজ মধ্য পর্যায়ে পৌঁছল । চতুর্থ দফার ভোট গ্রহণ শেষ হল ৷ এখনও বাকি আরও চার দফা ৷ তার পর গণনা ৷
তীব্র তিক্ততার বাতাবরণ ছুঁয়ে ভোটগ্রহণ পৌঁছাচ্ছে পঞ্চম দফায় । চতুর্থ দফায় পাঁচটা মৃত্যু প্রত্যক্ষ করল বাংলা ৷ স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ না হওয়ায় কমিশনের পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল ৷ নির্বাচনী তিক্ততা বা নির্বাচনী হিংসা পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু নয় । যে কোনও স্তরের নির্বাচনে হিংসার সাক্ষী হতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে এরাজ্য । কিন্তু তিক্ততা যে চরম পর্যায়ে পৌঁছল, নির্বাচনের পঞ্চম দফার ভোটগ্রহণের আগে তা সত্যিই আতঙ্কের ৷
এ রাজ্যে গত দু-দশ বছরে বা তার একটু বেশি সময়ের মধ্যে কখনও মোটের উপর অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়নি, এমন নয় । 2008 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, 2009 সালে লোকসভা নির্বাচন বা 2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছিল । তাতে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে বাংলার জনসাধারণের আস্থা বেড়ে গিয়েছিল । সেই আস্থার প্রমাণ পরবর্তী নির্বাচনী মরসুমে বারবার মিলেছে বাংলার নানা প্রান্তে । কোথাও ভোটকর্মীরা আন্দোলনে নামছেন সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে ভোট পরিচালনা করার দাবিতে , কোথাও আবার ভোটাররা ভোটগ্রহণের দিনে রাস্তাঘাট অচল করে দিচ্ছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে ভোটগ্রহণ করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন । জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে আস্থা কতখানি থাকলে এই রকম ছবি তৈরি হয়, তা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না ।
সেই আস্থা বা ভরসা যদি নষ্ট হয়ে যায় এবারের নির্বাচনে, তাহলে গণতন্ত্রের পক্ষে যে সেটা একটা বড় ক্ষতি, সেটা বলা অত্যুক্তি হবে না ৷ অথচ, উপসর্গ কিন্তু অবাধ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশের আভাস দিচ্ছে না । চতুর্থ দফার নির্বাচনে যে ভাবে পাঁচটা প্রাণ চলে গেল তা নিঃসন্দেহে অনুকূল পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল ৷
কেন গুরুত্ব ছিল শনিবারের নির্বাচন...
প্রথমত, আজ ছিল 44 টা আসনে নির্বাচন ৷ ভোট হল হাওড়া, হুগলি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার এবং দক্ষিণ 24 পরগনায় ৷ একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী ছিলেন ৷ ছিলেন এক গুচ্ছ তারকা প্রার্থীও ৷
দ্বিতীয়ত, আজ ভাগ্য পরীক্ষা ছিল সিঙ্গুরের ৷ 34 বছরের বাম শাসনকে বস্তা বন্দি করতে যে দুটি আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অক্সিজেন দিয়েছিল, তার একটি যদি নন্দীগ্রাম হয় অপরটি নিঃসন্দেহে সিঙ্গুর ৷
তৃতীয়ত, গত লোকসভায় উত্তরবঙ্গে ঝড় তুলেছিল বিজেপি ৷ আজ সেই উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা ছিল তৃণমূল এবং বিজেপির ৷
কী ঘটল শনিবার...
সব আলো যেন কেড়ে নিল একটি কেন্দ্র ৷ শীতলকুচি ৷ ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকে দফায় দফায় শীতলকুচিতে সংঘর্ষ বাধে তৃণমূল এবং বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে । সকালে পাঠানটুলি শালবাড়ির 285 বুথে ভোট দিতে গিয়ে আনন্দ বর্মণ নামের এক 18 বছরের কিশোরের মৃত্যু হয় । তাঁর পরিবারের লোকজন নিজেদের বিজেপি সমর্থক বলে দাবি করলেও, আনন্দ কাদের পক্ষে, তা নিয়েও রাজনৈতিক টানাপড়েন চলতে থাকে দিনভর । আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাজ্যের ভোট মানচিত্রে একটি নামই উঠে আসে ৷ সেই শীতলকুচি ৷
প্রাণহানি দিয়ে দিন শুরু হয়েছিল । বেলা বাড়তে সেই শীতলকুচিতেই বাড়ল মৃতের সংখ্যা । এবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে সেখানে আরও 4টে প্রাণ গেল । বাহিনীর গুলিতে আরও চার জন জখম হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে । নিহতরা সকলেই তাঁদের সমর্থক বলে দাবি তৃণমূলের । শীতলকুচির জোড়পাটকির 126 নম্বর বুথের বাইরে এই ঘটনা ঘটেছে । গোটা ঘটনায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে । স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনী বিজেপি-র হয়ে কাজ করছে । রাতভর মদ-মাংস খেয়ে সকালে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে । সুষ্ঠু নির্বাচন করানোর ভার যাঁদের কাঁধে, তাঁদের নির্বিচারে গুলি চালানোর অধিকার কে দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জোড়াফুল শিবির । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে চেয়েছেন যে, যদি সত্যিই কেন্দ্রীয় বাহিনী আক্রান্ত হয়েছিল আমতলি স্কুলের 126 নম্বর ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে এবং ক্ষিপ্ত জনতা যদি সত্যিই তাদের মারতে উদ্যত হয়েছিল, তাহলে কেনও একজন জওয়ানেও আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল না ? অভিযোগের সুর এবং তীর নিয়ে কোনও সন্দেহ কারও থাকার কথা নয় ৷
অন্য দিকে, বিজেপি নেতা নিশীথ প্রামাণিক গোটা ঘটনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দায়ী করেছেন । তাঁর বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লাগাতার উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন মমতা । মাথাভাঙা, শীতলকুচি, কোচবিহারের সভা থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ধরতে বলেন তিনি আর তাতেই একটি বিশেষ শ্রেণির লোক উত্তেজিত হয় এবং আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে । কেন্দ্রীয় বাহিনী যদি গুলি চালিয়ে থাকে, তা আত্মরক্ষার্থেই চালিয়েছে ।’’
গোটা ঘটনায় ‘অ্যাকশন টেকন’ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন । প্রাথমিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে আত্মরক্ষার্থেই সিআইএসএফের বন্দুক থেকে গুলি চলেছিল ৷ তবে তাতেই 4টি তরতাজা প্রাণ গেল কিনা, তা জানা নেই কমিশনের ৷ পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর তা জানা যাবে ৷
কিন্তু, শেষ পর্যন্ত একটি প্রশ্ন থেকেই যায় ৷ এত নিরাপত্তারক্ষী, এত পুলিশ-বাহিনী এবং আট দফায় নির্বাচন করিয়ে লাভ কী হল?
কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং রাজ্যের পুলিশকে কাজে লাগিয়ে কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না কমিশন? যদি না পারে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কেনও রুটমার্চ করানো হচ্ছে না সংবেদনশীল এলাকাগুলোয়? পর্যাপ্ত বাহিনী কি এখনও এসে পৌঁছয়নি রাজ্যে? যদি না পৌঁছে থাকে, তাহলে আনানো হচ্ছে না কেন? আর যদি এসে গিয়ে থাকে, তাহলে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের তরফে কেনও তাদের সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না ? সব কটা প্রশ্নের জবাব কিন্তু কমিশনকেই দিতে হবে । ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে না হলে দায় কমিশনের উপরেই বর্তাবে ।
তবে শুধু নির্বাচন কমিশন কেন ? আজকের পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোও কি নিজেদের দায় এড়াতো পারে ? উত্তেজনামূলক বা উস্কানিমূলক কথা বলা থেকে এইবার কি তাঁরা বিরত থাকবেন ? অন্তত প্রথম 4 দফার রক্তাত্ত নির্বাচনের পর ?
একদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হিংসা বা অশান্তি কোনও পরিস্থিতিতেই কাম্য নয় । কিন্তু আমাদের রাজনীতিকে দুষ্কৃতীদের আনাগোনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমরা করে উঠতে পারিনি এখনও । অতএব বাহুবল মাঝেমধ্যেই হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে আমাদের গণতন্ত্রে । বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক উৎসব হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় যে দেশের নির্বাচনকে, তাকে ঘিরে বিন্দু প্রমাণ রক্তপাত ঘটলে অপমান হয় সাগর প্রমাণ । কিন্তু সে কথা আমরা আগেও মাথায় রাখিনি, এখনও রাখতে পারছি না ।
তাঁদের মতে, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আরও সক্রিয় হতে হবে । বিবদমান সব পক্ষকেই সংযত করতে হবে নানা স্তরে । কোনও নেতা বা নেত্রীর মুখ থেকে একটাও প্ররোচনামূলক শব্দের নিঃসরণ চলবে না । বাড়াবাড়ি করলে দেখে নেব অথবা কাকে কী ওষুধ দিতে হয় আমরাও জানি --- রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখ থেকে এই সব শব্দ ঠিকরে আসছে এখনও । এই ধরনের কথাবার্তা যে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে, তা এই নেতাদের অজানা নয় ।
তা সত্ত্বেও এই কুনাট্যরঙ্গ বহাল থাকতে দেওয়া কেন? উত্তর যত তাড়াতাড়ি আসবে, ততই আমজনতার উপকার ৷