ETV Bharat / state

Rajnagar History Fades Away: সেন বংশ থেকে পাঠান শাসন, সংস্কারের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রাজনগরের ইতিহাস

সেন বংশ থেকে পাঠান শাসনকালের ইতিহাস সমৃদ্ধ বীরভূমের রাজনগর (Rajnagar History Fades Away) সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের অভিযোগ তুললেন স্থানীয়রা (Birbhum News)৷ পর্যটক টানতে সরকারি উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা ৷

Rajnagar History Fades Away ETV Bharat
সংস্কারের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রাজনগরের ইতিহাস
author img

By

Published : Mar 8, 2023, 7:04 PM IST

সংস্কারের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রাজনগরের ইতিহাস

বীরভূম, 5 মার্চ: বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বংশের রাজাদের গড় ছিল বীরভূমের রাজনগর (Birbhum News)৷ কারণ পূর্ব-ভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশের অন্যতম পথ ছিল এটি । একদা এই রাজনগর রাঢ়বঙ্গের রাজধানী ছিল ৷ পাল, সেন, গঙ্গ বংশীয় হিন্দু রাজাদের শাসনকেন্দ্র ছিল এটি । পরবর্তীতে মুসলমান শাসকদের দখলে চলে যায় ৷ তাই ইতিহাসের মিশ্র নিদর্শন আজও রাজনগর জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে । সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে (Lack of maintenance) একদা বাংলা তথা ভারতে ইতিহাস কার্যত বিলুপ্তির পথে ৷ বর্তমানে এই রাজনগর ও তার কাহিনীসমূহ ধূলিময় ইতিহাসের পাতায় বন্দিমাত্র (Rajnagar History Fades Away)।

স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে রাজবংশের সদস্যদের দাবি, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রশাসন রাজনগরের রাজবাড়ি, স্নানাগার, মতিচূড়া মসজিদ, কালীদহ দিঘি, বারুদঘর, হাতিশালা প্রভৃতি সংস্কার করুক । যা একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রও হতে পারে ।

ইতিহাস থেকে জানা গিয়েছে, এই রাজনগরের প্রাচীন নাম ছিল 'লক্ষ্ণৌর'। যা রাজা বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনের নামানুসারে । তবে এই নামটি বল্লাল সেন রেখেছিলেন ? নাকি লক্ষ্মণ সেন ? তা নিয়ে ইতিহাসে দ্বিমত রয়েছে । এই 'লক্ষ্ণৌর' নামটি পরবর্তীতে লোকমুখে অপভ্রংশ হতে হতে হয় 'লক্ষর'। আরও পরে 'নগর' নাম হয় ৷ এরপর একাধিক রাজাদের গড় হওয়ায় এই স্থানের নাম হয় 'রাজনগর'।

Rajnagar History Fades Away ETV Bharat
সেন বংশ থেকে পাঠান শাসনকালের ইতিহাস সমৃদ্ধ বীরভূমের রাজনগর

সেন বংশের সময়কালে বীররাজাদের দখলে ছিল এই রাজনগর ৷ বখতিয়ার খিলজি থেকে শুরু করে গিয়াসউদ্দিন বলবন পর্যন্ত মুসলমান শাসকেরা বারবার বাংলা আক্রমণ করেছে । কিন্তু, বীররাজার শাসনকালে রাজনগরের চতুর্দিকে থাকা 12টি গড় ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা । একাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এই বীর রাজার নামানুসারেই 'বীরভূম' নামকরণ হয়েছিল ।

অনুমানিক 1600 খ্রিস্টাব্দে রাজনগরে শুরু হয় মুসলিম শাসকদের রাজত্ব ৷ উল্লেখ্য, পরাক্রমশালী বীররাজা যখন রাজনগরের সিংহাসনে বিরাজমান, তখন দুই পাঠান সেনানায়ক আসাদুল্লাহ খাঁ ও জোনেদ খান রাজনগরে আসেন ৷ নিজ নিজ পরাক্রমের পরিচয় দিয়ে রাজার বিশ্বাস অর্জন করেন তাঁরা ৷ পরে রানির সহযোগিতায় জোনেদ খান বীররাজা ও আসাদুল্লাহ খাঁকে হত্যা করে । রাজনগরে শুরু হয় পাঠানদের রাজত্ব ৷ 1757 খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা পরাজিত হওয়ায় বঙ্গের রাজারা এক এক করে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ শুরু করেন ।

Rajnagar History Fades Away ETV Bharat
হারিয়ে যাচ্ছে রাজনগরের ইতিহাস

ব্রিটিশদের রাজস্ব দেওয়া শুরু করেন বাংলার রাজা-জমিদারেরা ৷ কিন্তু, এই রাজস্ব দেওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন মীরজাফর পুত্র মীরকাশিম ৷ রাজনগর ও হেতমপুরের রাজাদের সঙ্গে বীরভূমের কড়িধ্যায় ইংরেজ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয় ৷ ইংরেজ গোলাবারুদের সামনে পরাস্ত হন দুই রাজাই ৷ এখান থেকেই ইংরেজদের গড় হয়ে ওঠে এই রাজনগর ৷

আরও পড়ুন: সার্ধশতবর্ষ পূর্তির দোরগোড়ায় কলকাতার ট্রাম, লক্ষ্মণরেখায় বন্দি পথেই শহরে চলমান ইতিহাস

ইতিহাসে আরও উল্লেখ আছে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে 1855 সালে 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' ঘোষণা হয় । সেই বিদ্রোহেরও অন্যতম গড় ছিল এই রাজনগর । তাই রাজনগর রাজবাড়ির কোণে কালীদহ দিঘির পাড়ে গাব গাছের নীচে সাঁওতাল নেতা মংলু মাঝি-সহ বহু বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশ সরকার ৷

এত এত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এই রাজনগরে আজও জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজবাড়ি, হামাম (যা রানিদের স্নানাগার), কালীদহ দিঘি ও তার মাঝে হাওয়া মহল, সেন বংশের দূর্গ, মতিচূড় মসজিদ । প্রসঙ্গত, রাজনগরে হিন্দু ও মুসলমান রাজারা শাসন করেছিল ৷ তাই মতিচূড় মসজিদের নির্মাণ কার্যে দুই সম্প্রদায়ের শিল্পীর কারুকাজের নিদর্শন মেলে ৷

এছাড়াও রাজনগরে রয়েছে বারুদখানা, হাতিশালা, সাঁওতাল বিদ্রোহীদের ফাঁসি দেওয়ার স্থান । তবে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে এক এক করে এই সব ঐতিহাসিক স্থানগুলি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে ৷ এখনও প্রশাসন যদি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে কমপক্ষে 700 বছরের বাংলা তথা ভারতের এক ইতিহাস ধ্বংসস্তুপের ইঁটে চাপা পড়ে যাবে ৷

রাজনগরের বাসিন্দা দেবব্রত নাথ বলেন, "রাজনগরে চতুর্দিকে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন পড়ে রয়েছে । সংস্কার ও সংরক্ষণ না করার ফলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ৷ একদিন মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে । আমাদের দাবি, প্রশাসন এ গুলিকে সংস্কার করুক ৷ তাহলে এটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে ৷"

রাজনগরের পাঠান বংশধর সফিউল আলম বলেন, "এক এক করে বহু রাজারা এখানে রাজত্ব করেছে ৷ বীর রাজার পর সুদূর আফগানিস্তান থেকে আগত পাঠানরা এখানে রাজত্ব করেছে ৷ বিশ্বাসঘাতকতা করে রানির সহযোগিতায় বীর রাজাকে পরাজিত করে ৷ আবার এই মতকে খণ্ডন করে ঐতিহাসিকদের আরেকটি মত হল, বীর রাজাকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করে পাঠান শাসন শুরু হয় ৷ আমি পাঠান বংশধর । এখানে ইতিহাসের বহু নিদর্শন রয়েছে । আমরা বারাবার দাবি করেছি প্রশাসনের কাছে এগুলি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হোক ৷ পর্যটন কেন্দ্র করতে যা যা দরকার করা হোক ।"

সংস্কারের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রাজনগরের ইতিহাস

বীরভূম, 5 মার্চ: বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বংশের রাজাদের গড় ছিল বীরভূমের রাজনগর (Birbhum News)৷ কারণ পূর্ব-ভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশের অন্যতম পথ ছিল এটি । একদা এই রাজনগর রাঢ়বঙ্গের রাজধানী ছিল ৷ পাল, সেন, গঙ্গ বংশীয় হিন্দু রাজাদের শাসনকেন্দ্র ছিল এটি । পরবর্তীতে মুসলমান শাসকদের দখলে চলে যায় ৷ তাই ইতিহাসের মিশ্র নিদর্শন আজও রাজনগর জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে । সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে (Lack of maintenance) একদা বাংলা তথা ভারতে ইতিহাস কার্যত বিলুপ্তির পথে ৷ বর্তমানে এই রাজনগর ও তার কাহিনীসমূহ ধূলিময় ইতিহাসের পাতায় বন্দিমাত্র (Rajnagar History Fades Away)।

স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে রাজবংশের সদস্যদের দাবি, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রশাসন রাজনগরের রাজবাড়ি, স্নানাগার, মতিচূড়া মসজিদ, কালীদহ দিঘি, বারুদঘর, হাতিশালা প্রভৃতি সংস্কার করুক । যা একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রও হতে পারে ।

ইতিহাস থেকে জানা গিয়েছে, এই রাজনগরের প্রাচীন নাম ছিল 'লক্ষ্ণৌর'। যা রাজা বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনের নামানুসারে । তবে এই নামটি বল্লাল সেন রেখেছিলেন ? নাকি লক্ষ্মণ সেন ? তা নিয়ে ইতিহাসে দ্বিমত রয়েছে । এই 'লক্ষ্ণৌর' নামটি পরবর্তীতে লোকমুখে অপভ্রংশ হতে হতে হয় 'লক্ষর'। আরও পরে 'নগর' নাম হয় ৷ এরপর একাধিক রাজাদের গড় হওয়ায় এই স্থানের নাম হয় 'রাজনগর'।

Rajnagar History Fades Away ETV Bharat
সেন বংশ থেকে পাঠান শাসনকালের ইতিহাস সমৃদ্ধ বীরভূমের রাজনগর

সেন বংশের সময়কালে বীররাজাদের দখলে ছিল এই রাজনগর ৷ বখতিয়ার খিলজি থেকে শুরু করে গিয়াসউদ্দিন বলবন পর্যন্ত মুসলমান শাসকেরা বারবার বাংলা আক্রমণ করেছে । কিন্তু, বীররাজার শাসনকালে রাজনগরের চতুর্দিকে থাকা 12টি গড় ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা । একাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এই বীর রাজার নামানুসারেই 'বীরভূম' নামকরণ হয়েছিল ।

অনুমানিক 1600 খ্রিস্টাব্দে রাজনগরে শুরু হয় মুসলিম শাসকদের রাজত্ব ৷ উল্লেখ্য, পরাক্রমশালী বীররাজা যখন রাজনগরের সিংহাসনে বিরাজমান, তখন দুই পাঠান সেনানায়ক আসাদুল্লাহ খাঁ ও জোনেদ খান রাজনগরে আসেন ৷ নিজ নিজ পরাক্রমের পরিচয় দিয়ে রাজার বিশ্বাস অর্জন করেন তাঁরা ৷ পরে রানির সহযোগিতায় জোনেদ খান বীররাজা ও আসাদুল্লাহ খাঁকে হত্যা করে । রাজনগরে শুরু হয় পাঠানদের রাজত্ব ৷ 1757 খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা পরাজিত হওয়ায় বঙ্গের রাজারা এক এক করে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ শুরু করেন ।

Rajnagar History Fades Away ETV Bharat
হারিয়ে যাচ্ছে রাজনগরের ইতিহাস

ব্রিটিশদের রাজস্ব দেওয়া শুরু করেন বাংলার রাজা-জমিদারেরা ৷ কিন্তু, এই রাজস্ব দেওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন মীরজাফর পুত্র মীরকাশিম ৷ রাজনগর ও হেতমপুরের রাজাদের সঙ্গে বীরভূমের কড়িধ্যায় ইংরেজ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয় ৷ ইংরেজ গোলাবারুদের সামনে পরাস্ত হন দুই রাজাই ৷ এখান থেকেই ইংরেজদের গড় হয়ে ওঠে এই রাজনগর ৷

আরও পড়ুন: সার্ধশতবর্ষ পূর্তির দোরগোড়ায় কলকাতার ট্রাম, লক্ষ্মণরেখায় বন্দি পথেই শহরে চলমান ইতিহাস

ইতিহাসে আরও উল্লেখ আছে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে 1855 সালে 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' ঘোষণা হয় । সেই বিদ্রোহেরও অন্যতম গড় ছিল এই রাজনগর । তাই রাজনগর রাজবাড়ির কোণে কালীদহ দিঘির পাড়ে গাব গাছের নীচে সাঁওতাল নেতা মংলু মাঝি-সহ বহু বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশ সরকার ৷

এত এত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এই রাজনগরে আজও জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজবাড়ি, হামাম (যা রানিদের স্নানাগার), কালীদহ দিঘি ও তার মাঝে হাওয়া মহল, সেন বংশের দূর্গ, মতিচূড় মসজিদ । প্রসঙ্গত, রাজনগরে হিন্দু ও মুসলমান রাজারা শাসন করেছিল ৷ তাই মতিচূড় মসজিদের নির্মাণ কার্যে দুই সম্প্রদায়ের শিল্পীর কারুকাজের নিদর্শন মেলে ৷

এছাড়াও রাজনগরে রয়েছে বারুদখানা, হাতিশালা, সাঁওতাল বিদ্রোহীদের ফাঁসি দেওয়ার স্থান । তবে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে এক এক করে এই সব ঐতিহাসিক স্থানগুলি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে ৷ এখনও প্রশাসন যদি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে কমপক্ষে 700 বছরের বাংলা তথা ভারতের এক ইতিহাস ধ্বংসস্তুপের ইঁটে চাপা পড়ে যাবে ৷

রাজনগরের বাসিন্দা দেবব্রত নাথ বলেন, "রাজনগরে চতুর্দিকে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন পড়ে রয়েছে । সংস্কার ও সংরক্ষণ না করার ফলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ৷ একদিন মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে । আমাদের দাবি, প্রশাসন এ গুলিকে সংস্কার করুক ৷ তাহলে এটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে ৷"

রাজনগরের পাঠান বংশধর সফিউল আলম বলেন, "এক এক করে বহু রাজারা এখানে রাজত্ব করেছে ৷ বীর রাজার পর সুদূর আফগানিস্তান থেকে আগত পাঠানরা এখানে রাজত্ব করেছে ৷ বিশ্বাসঘাতকতা করে রানির সহযোগিতায় বীর রাজাকে পরাজিত করে ৷ আবার এই মতকে খণ্ডন করে ঐতিহাসিকদের আরেকটি মত হল, বীর রাজাকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করে পাঠান শাসন শুরু হয় ৷ আমি পাঠান বংশধর । এখানে ইতিহাসের বহু নিদর্শন রয়েছে । আমরা বারাবার দাবি করেছি প্রশাসনের কাছে এগুলি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হোক ৷ পর্যটন কেন্দ্র করতে যা যা দরকার করা হোক ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.