রামপুরহাট, 14 এপ্রিল : একজনকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, "সরকারি চাল পাচ্ছি । তাতে আপাতত কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছি । তবে হাতে একটি টাকাও নেই । জানি না আগামী দিনে কী হবে ।" আর একজন বললেন, "আমরা গামছা দিয়ে মুখ ঢাকছি । সরকারের তরফে মাস্ক বা স্যানিটাইজ়ার পাইনি । আমাদের কাছে এত টাকাও নেই যে মাস্ক কিনব ।"
রামপুরহাট থেকে দুমকা যাওয়ার রাস্তা । এই রাস্তা ধরে গেলেই কানে আসত পাথর ভাঙার আওয়াজ । সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শোরও বেশি পাথরের খাদান ও ক্রাশার রয়েছে সেখানে । প্রায় হাজার তিনেক লোক রোজই আসত এখানে । কিন্তু এখন সবকিছু কেমন পালটে গেছে । রাস্তাটা সেই একই আছে । গাড়িও অল্পবিস্তর যাওয়া আসা করছে । আছে সেই খাদানগুলিও । কিন্তু নেই সেই চেনা আওয়াজ । দুমকাগামী রাস্তাটার দু'পাশে খাদানগুলি যেন আজ বড্ড নিঃসঙ্গ ।
লকডাউনের পর থেকে কার্যত এই ছবি দেখা গেছে বীরভূমের বারোমাসিয়া এলাকায় । বারোমাসিয়া ও তার আশপাশের এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রায় 15টি আদিবাসী গ্রাম । আর এই গ্রামগুলির বেশিরভাগ বাসিন্দারই পেট চলে এই খাদানগুলিতে কাজ করে । আদিবাসী মহল্লাগুলির পুরুষ, মহিলা সকলেই কাজ করে এই খাদানগুলিতে । মহিলারা মূলত পাথরগুলিকে একজায়গায় জমা করার কাজ করে । দিনপিছু পায় 250 থেকে 300 টাকা । আর বোল্ডার ভাঙার কাজ করে মূলত পুরুষরা । এরা দিনপিছু পায় 400 থেকে 500 টাকা । কিন্তু লকডাউনের জেরে এখন বন্ধ রয়েছে খাদান ।
যাঁরা এখানে কাজ করেন, তাঁদের বেশিরভাগই দিনমজুর । কিন্তু এখন কাজ নেই । তাই টাকাও নেই । ঘরে যেটুকু সঞ্চয় রয়েছে তাও ফুরোতে বসেছে । ঘরে খাবারও বাড়ন্ত । কোনওদিন একবেলা আবার কখনও না খেয়েই দিন কাটছে । তাঁদের বক্তব্য, কোরোনায় না মরলেও না খেতে পেয়েই হয়তো প্রাণটা যাবে ।
রামপুরহাট পাথর ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরী সম্পাদক আশাই শেখ বলেন "এভাবে খাদান বন্ধ থাকলে এলাকায় মহামারী শুরু হয়ে যাবে। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয় বীরভূমে । সব বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। আমরা রামপুরহাট পাথর ব্যবসায়ী সমিতির তরফে আদিবাসী গ্রামগুলিতে চাল, ডাল, আলু পাঠানোর ব্যবস্থা করছি । তবে কতদিন পারব জানি না ।"
শুধু বারোমাসিয়া নয়, রামপুরহাটের বড় পাহাড়ি, সালবাদরা সহ বিস্তীর্ণ এলাকার ছবিটা একইরকম । রয়েছে নলহাটির বাহাদুরপুর, মুরারইয়ের রাজগ্রাম, সন্তোষপুর সহ এমন আরও অনেক এলাকা । শুধু শ্রমিকদের নয়, মালিকদের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাঁজ । এক একটি ক্রাশারে মজুত রয়েছে লক্ষাধিক টাকার পাথর । লকডাউন ওঠার পর মজুত পাথরের কতটা দাম পাওয়া যাবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পাথর ব্যবসায়ীরা ।
এই ক্রাশারগুলিকে ঘিরে সেখানে গজিয়ে উঠেছে কিছু খাবারের দোকান, ওয়েল্ডিং কারখানা, টায়ার মেরামতির দোকান । খাবারের দোকানগুলি যদিও লকডাউনের আওতা থেকে বাইরে, কিন্তু দেখা নেই খদ্দেরের । থাকবেই বা কীভাবে? দোকানগুলিতে যাঁরা খেতে আসেন, তাঁরা সবাই তো এই খাদানেরই শ্রমিক । এখন খাদান বন্ধ । তাই দেখা নেই খদ্দেরেরও ।