বীরভূম, 22 ফেব্রুয়ারি: পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আস্ত একটি গ্রাম ৷ নেপথ্যে হাতির হানা (Fear of Elephants)৷ ঝাড়খণ্ড-বীরভূম সীমান্তে পটলপুর গ্রামটি এখন নামে মাত্র । একদা 25 থেকে 30টি বাড়িতে 100-রও বেশি মানুষের বসবাস ছিল । এখন তা ঠেকেছে মাত্র দু'টি পরিবারে ৷ আতঙ্কে কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা (Story of the Fear of Elephant Attack)। গ্রাম জুড়ে পড়ে রয়েছে বহু পরিত্যক্ত বাড়ি, উঠান, কল, তুলসি মন্দির প্রভৃতি ।
খাদ্যের সন্ধানে রাতবিরেতে প্রায় সময় ঝাড়খণ্ডের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে দলে দলে হাতি ঢুকে পড়ে গ্রামে । ফসল নষ্ট থেকে শুরু করে রীতিমতো বাড়িঘর ভাঙচুর করার পাশাপাশি একপ্রকার তাণ্ডব চালায় হাতির পাল । এই ভয়েই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন অধিকাংশ বাসিন্দা (Birbhum News)। বীরভূম জেলার রাজনগর থানার রাজনগর-গাংমুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পটলপুর গ্রাম (Elephant Attack Patalpur Rajnagar Village)৷ একেবারে ঝাড়খণ্ড সীমান্তে পাহাড়ের পাদদেশে এই গ্রাম । গ্রাম থেকে মাত্র 500 মিটার দূরেই ঝাড়খণ্ড । অন্যদিকে, বয়ে গিয়েছে সিদ্ধেশ্বরী নদী ও বিস্তীর্ণ জঙ্গল । একদা, এই পটলপুর গ্রামে 25 থেকে 30টি পরিবারের বাস ছিল । 100 জনেরও বেশি মানুষের বসতি নিয়ে পাহাড়-নদীর কোলে শোভা পাচ্ছিল সবুজে ঘেরা পটলপুর ৷ কাল হল হাতির হানা ৷
প্রায় সময় ঝাড়খণ্ডের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে খাদ্যের সন্ধানে দলে দলে হাতি গ্রামে ঢুকে পড়ে ৷ কখনও 18 থেকে 20 তো কখনও 25 থেকে 30টি হাতির দল, কখনও বা তারও বেশি ৷ চাষের ফসল খেয়ে ও মারিয়ে নষ্ট করে দেওয়া তো রয়েইছে ৷ একেবারে বসতি এলাকায় ঢুকে বাড়িঘর ভাঙচুর করতে থাকে হাতি ৷ আর এই হাতির হানার আতঙ্কে একে একে গ্রাম ছেড়েছেন বাসিন্দারা ৷ আজ এই পটলপুর গ্রামে মাত্র দুটি পরিবার এসে টিকেছে ৷ বাকিরা গ্রাম ছেড়ে কেউ সিউড়িতে, কেউ রাজনগরে, কেউ মহম্মদবাজারে, কেউবা পাশেই জয়পুর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে । 2008-09 সাল থেকেই ধীরে ধীরে গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছেন বাসিন্দারা ৷
আরও পড়ুন : ক্যামেরায় ধরা পড়ল কাঁঠাল চোর, জানেন সে কে ?
বর্তমানে গ্রাম জুড়ে পড়ে রয়েছে কাঁচা-পাকা ভগ্নপ্রায় বাড়িঘর, জলের কল, তুলসি মন্দির, উঠান, ধানের গোলা, বিভিন্ন ফলের গাছ প্রভৃতি । এই গ্রামের জমি-জায়গাও তো কেউ কিনতে আসে না । অর্থাৎ, হাতির হানা ও বেশ কিছুটা দুর্গম রাস্তার জন্য এই গ্রামে কেউ আসতে চায় না । আর এতে বনবিভাগের গাফিলতিকেই দায়ি করছে পটলপুর । যে দুটি পরিবার থাকেন তাদের বাড়িতে 3টি বাচ্চা রয়েছে ৷ হাতির তাণ্ডবের কথা মনে পড়তেই রীতিমতো আঁতকে ওঠেন বাবা-মায়েরা ৷
2017 ও 2022 সালে এই গ্রামের প্রবীণ চাষি উজ্জ্বল দাস পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'কৃষক রত্ন' পুরস্কার পেয়েছেন ৷ এবারও তিনি মটরশুঁটি, আলু, ধনেপাতা, আখ, ভুট্টা, সরষে, আম চাষ করেছেন । তিনি বলেন, "আমরা দুটি পরিবার এখন থাকি ৷ হাতির ভয়ে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে ৷ সব বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ে আছে । দিন-রাত দলে দলে হাতি ঢুকে পড়ে ৷ কয়েকদিন আগেও এসেছিল । তবে গ্রামে ঢোকেনি । আর গ্রামে সরকারি কোনও সুবিধাও নেই । হাতি যদি 1 লক্ষ টাকার ক্ষতি করে তাহলে 5 হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ মেলে ।"
আপনি কেন গ্রাম ছেড়ে যাননি ? প্রশ্ন করতেই তাঁর উত্তর, "কোথায় যাব ৷ আমার এই গ্রামের জমি-জমা কে কিনবে ৷ আর অন্য জায়গায় গিয়ে বাস করার টাকা নেই ৷ তাই ভয়ে ভয়েই বাকি জীবনটা এই গ্রামেই কাটিয়ে দেব । বাইরে গিয়ে না খেয়ে মরার চেয়ে এখানে থেকে হাতিতে মারলে মারবে ।"
আরও পড়ুন : ঠেলতে ঠেলতে সদ্যোজাতকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মা, মানবিক হাতির ভিডিয়ো ভাইরাল ঝাড়গ্রামে
স্থানীয় বাসিন্দা চন্দনা দাস বলেন, "নিজের চোখে হাতির তাণ্ডব যা দেখেছি বর্ণনা করার মত নয় । ঘরবাড়ি সব ভেঙেছে । রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি । হাতির ভয়ে পাশের গ্রাম জয়পুরেও রাত কাটাতে হয়েছে । এই হাতির ভয়েই আজ গ্রাম ফাঁকা ।" আরেক বাসিন্দা বাবলু দাসের কথায়, "একদিন দেখি হাতি এসে আমার ঘরের দরজা মাথা দিয়ে ধাক্কা মেরে ভাঙছে । আমি আর মা মৃত্যুভয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ৷ তারপর হাতি দরজা দিয়ে শুঁড় ঢুকিয়ে ঘরের ভিতরে খাবার খুঁজছিল ৷ না পেয়ে চলে গেল ৷ আমি যেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলাম ৷ এই রকম অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে ৷ এই ভয়েই গ্রাম আজ শূন্য ৷ বনবিভাগকে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি ৷"
এই বিষয়ে শুধুমাত্র হাতি তাড়ানোর কথা বলে অবশ্য দায় সেরেছে স্থানীয় বনবিভাগ ৷ রাজনগর রেঞ্জের রেঞ্জার কুদরতে খোদা বলেন, "জঙ্গল পেরিয়ে হাতি তো প্রায় ঢুকে পড়ে ৷ এখন আমরা 'ঐরাবত' নামে একটা গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে লোকালয় থেকে হাতি তাড়াই । আর মানুষজনের কাছে প্রার্থনা করি যাতে হাতির কাছে কেউ না যায় । 'গজমিত্র' নামে আমাদের লোকও ওই এলাকায় আছে । তারাই হাতি এলে খবর দেয় ।"
আরও পড়ুন : জলপাইগুড়ির একাধিক গ্রামে কীসের ভয়ে বিকোচ্ছে এত কাঁঠাল ?