বাঁকুড়া, 3 সেপ্টেম্বর : ইট বের করা স্থাপত্যের কঙ্কাল ৷ চারপাশ ভরা অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাছা আর জংলা ঝোপঝাড়ে ৷ কোনও মতে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ থামের গায়ে বাঁধা রয়েছে একটা দড়ি ৷ যার অপর প্রান্ত আটকানো আর একটা থামে ৷ সেই দড়িতেই শুকোচ্ছে আধ-ময়লা একটা মাস্ক ৷ আমরা দাঁড়িয়ে আছি বাঁকুড়ার হরিহরগঞ্জের রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে ! অবাক হবেন না ৷ এটাই এখানকার রাজবাড়ি ৷ অন্তত এককালে তেমনটাই ছিল ৷ রাজ পরিবারের উত্তরসূরী হরিপদ সিংহ দেব ইটিভি ভারতকে জানালেন তাঁদের হতাশা আর যন্ত্রণার কথা ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন বিপিএল তালিকাভুক্ত ৷ এই রাজবংশের গৌরব কারও জানা নেই ৷ আমরা চাই, সেটুকু অন্তত মানুষ জানুক ৷’’
আরও পড়ুন : ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগ, ধ্বংসের মুখে রায়পুর রাজবাড়ি
ইতিহাস জানানোর দায় কার, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে ৷ কিন্তু ইতিহাস জানার দায় বোধ হয় কম-বেশি আমাদের সকলেরই ৷ আমরা যাঁরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক, তাঁদের বেশিরভাগই জানি না ভিনদেশিদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে মূল স্রোতের বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে অসংখ্য লড়াই হয়েছিল ৷ যার অধিকাংশই আজও ইতিহাস বইয়ের নাগালের বাইরে ৷ বাঁকুড়া জেলার রাইপুরের হরিহরগঞ্জও এমন অনেক লড়াই আর বীরত্বের সাক্ষী ৷ আজ সেসব ঢাকা পড়েছে আগাছার আড়ালে ৷ সরকারি আর প্রশাসনিক অনীহায় ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে ইতিহাস ৷
শতাধিক বছর আগের কথা ৷ বাংলার তখন শাঁখের করাতের দশা ৷ একদিকে বর্গী হানা, আর অন্যদিকে ব্রিটিশ আগ্রাসন ৷ সেই সময় বাঁকুড়ার রাইপুরের রাজা ছিলেন দুর্জন সিংহ দেব ৷ প্রজাদের সঙ্গে নিয়েই বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন তিনি ৷ ইতিহাসের পাতায় সেই যুদ্ধের পরিচয় করানো হয় চুয়াড় বিদ্রোহ নামে ৷ শোনা যায়, রাজপ্রাসাদের মধ্যেই ছিল একটি গোপন এবং গভীর গুহা ৷ সেখানেই লুকোনো থাকত অস্ত্রশস্ত্র ৷ পরবর্তীতে দুর্জন সিং দেবের ছেলে ফতে সিংহ দেবও বীর বিক্রমে লড়েছিলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে ৷ কিন্তু শেষমেশ তাঁকে পরাজিত হতে হয় ৷ রাজাকে বন্দি করে ব্রিটিশ হামলাকারীরা ৷ পরিস্থিতির চাপে সন্ধি করতে বাধ্য হন ফতে সিংহ দেব ৷ স্থির হয়, রাজপাট তাঁর থাকবে ৷ বদলে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইংরেজ শাসককে দিতে হবে বছরে 22 হাজার টাকা !
ফতে সিংহ দেবের পর রাজত্ব পান তাঁর ছেলে বীর সিং দেব ৷ এরপর তৈরি হয় আর এক জটিলতা ৷ বীর সিংহ দেবের ছিলেন দুই রানি ৷ বড় রানির ছেলে রঘুনাথ সিংহ দেব এবং ছোট রানি ছেলে হরিহর সিংহ দেব ৷ দু’জনেরই জন্ম একই দিনে ৷ তবে হরিহরের জন্ম হয় সকালবেলা এবং রঘুনাথের জন্ম হয় বিকেল বেলা ৷ তাই রাজত্ব কে পাবে, তা নিয়ে বাধে বিবাদ ৷ শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে বয়সে বড় হরিহরকেই রাজা বলে ঘোষণা করা হয় ৷ সিংহ দেব বাড়িতে রচিত হয় নতুন ইতিহাস ৷ গড়ে ওঠে নতুন নগর ‘হরিহরগঞ্জ’ ৷
আরও পড়ুন : ইতিহাস আর পর্যটনের মেলবন্ধন ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি
সেই হরিহরগঞ্জ আজও আছে ৷ আছে রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ ৷ রয়েছেন রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারীরাও ৷ আজও খাতায়-কলমে তাঁরা ‘রাজা’ই থেকে গিয়েছেন ৷ কিন্তু রাজবাড়ি তার শ্রী হারিয়েছে ৷ বেড়েছে জঞ্জাল আর আবর্জনার স্তূপ ৷ ঠাকুরদালানটুকু চলনসই থাকলেও প্রাসাদের বাকি অংশের অবস্থা শোচনীয় ৷ রোদ, বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে জায়গায় জায়গায় টিনের চাল আটকেছেন রাজার নাতি, পুতিরা ৷ আজ তাঁরা হতদরিদ্র ৷ পেট চলে রেশনের মোটা চালে ৷ কে জানে ? হয়তো তাঁদের এই দশা দেখে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজবাড়ির দালান, খিলান !