জয়পুর : কালের নিয়মে বিলীন হয়ে গেছে জমিদারি ৷ ভগ্নপ্রায় দশা বাড়িরও ৷ ধসে পড়েছে একটা অংশ ৷ চারপাশে ফোকলা দাঁতের মতো বেরিয়ে আছে ইট ৷ তারই মধ্যে অমলিন হয়ে রয়েছে প্রথা, পরম্পরা ও ঐতিহ্য ৷ আর তাকেই সম্বল করে এখনও পুজোর চারটে দিন আলোয় ঝলমল করে ওঠে বাঁকুড়ার জয়পুরে ব্লকের ময়নাপুর গ্রামের মুখোপাধ্যায় বাড়ি ৷
একসময় মল্ল রাজাদের দাপট ছিল বিষ্ণুপুরে ৷ শেষ মল্ল রাজা চৈতন্য সিংয়ের দেওয়ান ছিলেন ময়নাপুরের চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায় ৷ কিন্তু, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে মল্ল রাজাদের ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে ৷ ব্রিটিশদের চাপানো অতিরিক্ত করে জর্জরিত হয়ে পড়েন তাঁরা ৷ একের পর এক তালুকের নিলাম শুরু হয় ৷ আর তখন ময়নাপুরের জমিদারি পায় মুখোপাধ্যায় পরিবার ৷ কথিত আছে, একদিন স্বপ্নাদেশ পান চণ্ডীচরণ ৷ পরিবারের এক সদস্য শোনালেন সেই কাহিনি ৷ তিনি বলেন, "একদিন চণ্ডীচরণ না কি স্বপ্ন পান দেবী দুর্গার ৷ তিনি বলেন, তুই পাকা বাড়িতে আছিস আর আমি কাঁচা বাড়িতে ! চণ্ডীচরণ বলেন, আজ থেকে যা রোজগার করব তা দিয়ে তোমার জন্য মণ্ডপ করব ৷ সেদিনই তিনি যে টাকা পান তা দিয়ে দুর্গা দালান তৈরি করেন ৷ 1791 সাল থেক শুরু হয় দুর্গাপুজো ৷ " পরে চণ্ডীমণ্ডপ তৈরি হয় ৷ সেখানেই পুজো হতে থাকে ৷
ওই সদস্য জানান, সেই সময় পুজোতে জাঁকজমকের শেষ ছিল না ৷ পুজোর চারদিন গমগম করত চণ্ডীমণ্ডপ ৷ চলত যাত্রাপালা , রামায়ণ গান ৷ প্রতিদিন বসত ভোজসভা ৷ পুরো ময়নাপুর গ্রাম ছাড়াও নিমন্ত্রিত থাকত তালুকের প্রজারা ৷ কিন্তু, কালের অমোঘ নিয়মে জমিদারি গেছে ৷ এক সময় ফুলে ফেঁপে ওঠা কোষাগারে টান পড়েছে ৷ কমে গেছে পুজোর জৌলুস ৷ পাশপাশি, পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন ৷ ফলে পরিচর্যার অভাবে ভেঙে পড়েছে বাড়ির একটা অংশ ৷ এককালের লাল ইটের দেওয়ালে এখন সবুজ শ্যাওলার বাড়বাড়ন্ত ৷ আষ্টেপৃষ্টে রয়েছে গাছের ডাল ৷ তারই মধ্যে পরিপাটি করে সাজানো চণ্ডীমণ্ডপ যেন একটুকরো পরম্পরার মন ভালো করে দেওয়া ছবি ৷
বাঁকুড়ার ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই পুজো । পরিবারের এক সদস্য জানান, আগে অষ্টমীর পুজো শুরুর আগে মল্ল রাজারা তোপ দাগতেন ৷ তা শুনে তোপ দিয়ে শুরু হত মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো ৷ একইভাবে সন্ধি পুজোর সময় তোপ দেওয়া হত ৷ এখন যদিও তা আর হয় না ৷ আগের মত দশমীর দিন ওড়ানো হয় না নীলকণ্ঠ পাখিও ৷ 2004 সালের আগে পর্যন্ত ছাগ বলিও দেওয়া হত ৷ ওই সদস্য বলেন, "আগে সপ্তমী ও নবমীতে বলি দেওয়া হত ৷ এভাবেই পরম্পরা মেনে আসতাম ৷ 2004 সালে এই প্রথা বন্ধ করে দিতে বলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৷ তখন অবশ্য সপ্তমীর বলি হয়ে গেছিল ৷ তাঁর কথামতো সেই বছর নবমী থেকেই বলি প্রথা উঠে যায় ৷ "
আর এই প্রথা ও পরিবর্তনের মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়েই পুজো করে আসছেন মুখোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা ৷ সারা বছর বাইরে থাকলেও ঐতিহ্যের স্বাদকে চেটেপুটে নিতে এই কদিন চলে আসেন বাড়িতে ৷ ঐতিহ্যই যে তাঁদের চালিকাশক্তি তা অকপটে বলেন পরিবারের এক সদস্য ৷ তাঁর কথায়, "পারিবারিক পুজো বলে টিকিয়ে রেখেছি ৷"