বাঁকুড়া, 31 অক্টোবর : দক্ষিণবঙ্গের একটি সুপ্রাচীন জনপদ হল সোনামুখী ৷ যা কালী এবং কার্তিকের শহর নামে পরিচিত । আজ থেকে প্রায় 300 বছর আগে এই শহর ছিল ঝোপঝাড়ে ভরা, শহরের অলিগলিতে সেভাবে জনমানবের বসবাস শুরু হয়নি ৷ আজকের জনপদ সেই সময় জনগণ-শূন্য হলেও একটা সুপ্রাচীন ইতিহাস বহন করে নিয়ে চলত, যা হল কালীপুজোর ইতিহাস । এই ব্যস্ত শহরেই, শহুরে জীবনের পাশে একটা ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে ৷
একটা সময় এই প্রাচীন জনপদের বাসিন্দাদের আর্থিক অনটন ছিল চরমে । সেই সময় পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতে সোনামুখীর আদিবাসিন্দা সূত্রধর পরিবারের এক বিধবা রমণী চিড়ের ফেরি করতে ঘুরে বেড়াতেন এদিক-সেদিক । একদিন বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় চিড়ের ফেরি করতে গিয়ে সেই রমণীর সঙ্গে পথে দেখা হয় এক সুন্দরী বাচ্চা মেয়ের । সেই বাচ্চা মেয়ে এই সূত্রধর রমণীকে বারবার কাতর আর্জি জানিয়ে বলে, ‘'আমাকে তোর সঙ্গে নিয়ে চল ৷ তোর গ্রামে নিয়ে চল আমাকে ৷'’
কিন্তু ওই বয়স্ক মহিলা কিভাবে বাচ্চাটাকে নিয়ে আসবে ? কারণ তাঁর সঙ্গে থাকত চিড়ের ঝুড়ি ৷ ফলে সূত্রধর রমণী প্রতিদিন বিষয়টাকে এড়িয়ে গেলেও, বাচ্চা মেয়েটির বারবার কাতর আর্তি তাকে বাধ্য করেছিল তাকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে আসার জন্য । সূত্রধর রমণী বাচ্চাটিকে বলেন, ‘'চল ৷ তোকে আমি আমার ঝুড়ি করেই নিয়ে যাব ।'’ এতদুর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল ৷ কিন্তু যখনই বাচ্চা মেয়েটিকে ঝুড়িতে তুলে মাথায় নিয়ে সোনামুখী জনপদে ওই রমণী পৌঁছল, তখনই বাঁধল এক বিপত্তি ৷ রমণী দেখল ঝুড়িতে আর বাচ্চা মেয়েটি নেই, আছে কেবল একটি প্রস্তরখণ্ড । কাছাকাছি একটি আঁকড় গাছের তলায় সেই প্রস্তরখন্ডটিকে নামিয়ে রাখেন সূত্রধর রমণী । সেই সময় সেই আঁকড় গাছের নিচে 'হট সাধু' নামে এক যোগী বসবাস করতেন । সেই হট সাধু একদিন মায়ের স্বপ্নাদেশ পান যে এই প্রস্তরখণ্ডটিকে মাতৃরুপে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রাণ দিতে হবে । ঠিক তখন থেকেই ওই আঁকর গাছের তলায় কালীপুজো শুরু হয়, হটনগর কালী নামে ৷
আরও পড়ুন : 108 নরমুণ্ড উৎসর্গ করে পুজো, দীপাবলির রাতে আজও জেগে ওঠে বিষ্ণুপুর শ্মশান
ঠিক তার কয়েকদিন পরেই ঘটল আরেক ঘটনা ৷ সোনামুখীর তৎকালীন জমিদারের গিন্নিও মায়ের স্বপ্নাদেশ পেলেন যে ওই আঁকর গাছের ঠিক পাশেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হবে । মায়ের নির্দেশমতো জমিদার গিন্নি নিজেদের জমি দান করে তৈরি করলেন মায়ের সুবিশাল মন্দির । আজও একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেই আঁকড় গাছ এবং সেই প্রস্তরখণ্ড বিদ্যমান ৷ একইভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পূজিত হয়ে আসছে মাতৃরূপী ঐ প্রস্তরখণ্ডটিও । প্রথমে প্রস্তরখণ্ড পূজিত হওয়ার পর মায়ের মন্দিরে শুরু হয় মাতৃ আরাধনা, আজও সূত্রধর পরিবারের বংশধরেরা মায়ের ঘট প্রতিষ্ঠা এবং বিসর্জনের কাজ করে থাকেন ।