আলিপুরদুয়ার, 10 মে : আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকের দক্ষিণ পোরোবস্তি । শহর থেকে মাত্র 15 কিলোমিটার দূরে । 31-C জাতীয় সড়কের ধারে দক্ষিণ পোরোবস্তির যাত্রী প্রতীক্ষালয় । সেখান থেকে আর কিছুটা হেঁটেই রাভাদের গ্রাম । রাভা । ইন্দো-মোঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই উপজাতি । আলিপুরদুয়ার জেলায় টোটো, বোরোসহ যে ক'টি উপজাতি সম্প্রদায়ের বাস, তার মধ্যে একটি এই রাভা । এখানেই বাস 29 টি রাভা পরিবারের । চারিদিকে জঙ্গলে ঘরে । বক্সার জঙ্গল । আর তারই মাঝে এই গ্রাম ।
কিন্তু লকডাউনের পর থেকে এই রাভাদের এই গ্রাম কার্যত পুরুষহীন । পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে, কাজের সন্ধানে গ্রামের সব পুরুষ পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে । কিন্তু দীর্ঘ লকডাউনে বাড়ি ফিরতে পারেননি ওরা কেউই । টাকাও পাঠাতে পারেননি বাড়িতে । টানা লকডাউনে এখন চোখের জল রাভা গ্রামে । কোনওদিন অনাহারে, কোনওদিন অর্ধাহারে দিন কাটছে গ্রামের মহিলাদের ।
সরকারের তরফে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । চাল, আটা পাচ্ছেন ঠিকঠাকই । কিন্তু তাই দিয়েই বা কতদিন ? শুরু হয়েছে খাদ্যের হাহাকার । প্রাণে বাঁচতে গোটা গ্রামের মহিলারা এখন পুরোপুরি জঙ্গল নির্ভর । পেটে যে খিদে ৷ তাই প্রাণের মায়া একপ্রকার ত্যাগ করেই বক্সার জঙ্গলে ঢুকছেন খাবারের সন্ধানে । জঙ্গলের কচু, বুনো ওল, জঙ্গলি আলু । আপাতত এটাই ওদের বাঁচার রসদ ।
গ্রামে আবার রয়েছেন দুই অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও । কার্যত পুরুষহীন গ্রামে তাঁদেরও দেখাশোনা ভার পড়েছে গ্রামের বাকি মহিলাদের উপর । চারিদিকে জঙ্গল । সন্ধ্যা নামলেই শোনা যায় হাতি, বাইসন, চিতাবাঘ, বুনো শুয়োরের ডাক । কিন্তু পেট যে বড় বালাই । তাই সেসব কিছুকে উপেক্ষা করেই রাভা মহিলারা জঙ্গলে যান খাবাবের খোঁজে ।
পুরুষ শূন্য এই গ্রামের মহিলাদের লড়াইয়ের করুণ কাহিনী এখনও পৌছায়নি প্রশাসনের কানে । কোরোনা-আবহে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে রাভা মহিলারা সকলেই যেন এখন এক-এক জন ঝাঁসির রানি ।
গোটা গ্রামের 29 টি পরিবারের সকল পুরুষই লকডাউনের কারণে কেরালা, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশে আটকে পড়েছেন । এখনও পর্যন্ত একজন পুরুষ ও গ্রামে ফিরতে পারেনি । আর লকডাউনের পর থেকে ভিন রাজ্যেও কাজ বন্ধ । উপার্জন বন্ধ । পরিবারের কাছে টাকা পয়সাও পাঠানো বন্ধ দু'মাস ধরে ।
গ্রামেরই এক গৃহবধু রূপালি রাভাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি । বলেন, "তাঁর স্বামী কয়েক মাস আগে কেরালায় গেছেন কাজের সন্ধানে । সেখানে রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। কিন্তু এখন কাজ বন্ধ । উপার্জন নেই । বাড়িতেও টাকা আসেনি । কাজ করার লোক নেই । খাবার দেওয়ার লোক নেই । "
গ্রামের অন্য এক গৃহবধু চিরঞ্জীবি রাভার মুখেও একই কথা । তাঁর স্বামীও কেরালায় আটকে পড়েছেন । স্বামীকে কীভাবে বাড়ি ফেরাবেন, কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি । গ্রামেরই অন্য এক মহিলা রাঞ্জোলি রাভা । ছেলে কাজ করতে কেরালায় গেছে । কিন্তু এখন কাজ বন্ধ । বলছেন, " ছেলের সঙ্গে প্রায়ই কথা হয় ফোনে । ছেলে বলে, দেখতে ইচ্ছা করছে তোমাদের । কিন্তু কী করব?"
আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসক সুরেন্দ্র কুমার মীনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "বিষয়টি আমার জানা নেই । আমি সংশ্লিষ্ট ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব ।" পাশাপাশি এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি ।
একদিকে পুরুষ শূন্য গ্রাম । অন্যদিকে অর্থের অভাব । এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে চরম বিপাকে রাভা গ্রামের মহিলারা । অপলক দৃষ্টিতে বক্সার জঙ্গলের গভীরতা ভেদ করে তাঁদের চোখ এখন 31-C জাতীয় সড়কের ধারে পোরোবস্তির যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের দিকে । ভিন রাজ্যে থেকে তাঁদের প্রিয়জনদের দ্রুত ফিরিয়ে আনবে প্রশাসন, এই আশাতেই দিন গুনছেন রাভা মহিলারা ।