কলকাতা, 13 জুলাই : ছোটবেলা থেকেই স্বপ্নটা দেখতেন ৷ কিন্তু তখন অলিম্পিকসের মঞ্চটা কোনও দূর গ্রহের বস্তু বলে মনে হত ৷ স্বপ্নটাকে মনের কোনও এক জায়গায় লালন করে এসেছেন ৷ আর সামনে আসা সব চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন ৷ কঠোর পরিশ্রম ও লক্ষ্যে অবিচল থাকার ফল পাচ্ছেন সুতীর্থা ৷ তারই ফল পাচ্ছেন নৈহাটির টেবিল টেনিস খেলোয়াড় সুতীর্থা মুখোপাধ্যায় ৷ বাংলার যে দুজন খেলোয়াড় টোকিয়ো অলিম্পিকসে অংশ নেবেন তাঁদের মধ্যে একজন নৈহাটির সুতীর্থা ৷
বাঙালির অলিম্পিক যাত্রার ইতিহাস লেখা হলে বছর পঁচিশের এই তরুণীর হাল না ছাড়া মনোভাবের কথা অবশ্যই থাকবে । 2015 সালে বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগে নির্বাসন হয় সুতীর্থার ৷ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলেন ৷ কিন্তু একজন খেলোয়াড়কে জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয় ৷ সুতীর্থাও সেটাই করেছিলেন ৷ কঠিন সময় পেরিয়ে আজ টোকিয়োর বিমান ধরার অপেক্ষায় সুতীর্থা ৷
সম্প্রতি সোনিপথে ভারতীয় দলের শিবির থেকে কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে এসেছিলেন । তবে নৈহাটির আদি বাড়ি নয়, সুতীর্থা ছিলেন যাদবপুরে ভাড়া নেওয়া বাড়িতে । অনুশীলনের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা । মিহির ঘোষের কোচিংয়ে সুতীর্থার স্ফুরণ হলেও বর্তমানে তাঁর আরও পরিস্ফুটন সৌম্যদীপ রায়ের কড়া অনুশীলনে ৷ পৌলমী ঘটকের নজরদারিতে । চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে টোকিয়োর উদ্দেশে কলকাতা ছাড়বেন অর্জুন পুরস্কারের জন্য মনোনীত বাঙালি টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ।
দেশের অন্যতম সেরা মহিলা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় সুতীর্থা ইতিমধ্যে কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছেন । জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব তাঁর দখলে এসেছে । তবে অলিম্পিকসের এরিনায় বোর্ডে দাঁড়ানোর সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা করতে চান না সুতীর্থা । তাঁর কথায়, "ছোটবেলার স্বপ্ন অলিম্পিকে অংশগ্রহণ । তাই স্বপ্নপূরণ হওয়ার সঙ্গে ভাল পারফরম্যান্স জরুরি । আমি সেই লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করছি । সোনিপথে ভারতীয় দলের শিবিরে প্রস্তুতি নিয়েছি । এখানে সৌম্যদীপ রায়ের কাছেও নিজের ত্রুটি বিচ্যুতি সারিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি । ফিটনেস ট্রেনিং, বোর্ডে খেলা, ম্যাচ সিচুয়েশন প্র্যাকটিস সব করছি ৷"
আরও পড়ুন : Pranati Nayak : অলিম্পিকস পদকের স্বপ্নে বুঁদ জিমন্যাস্ট প্রণতির গ্রাম পিংলা
তাঁর প্রস্তুতিতে খুশি কোচ সৌম্যদীপ রায় । ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও আজকের সুতীর্থাকে তৈরি করার কারিগর এই প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন । বললেন, "সুতীর্থার সামনে বড় লক্ষ্যমাত্রা ছুড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ছোট ছোট লক্ষ্য সামনে রেখেছিলাম । পাঁচশো থেকে ক্রমতালিকায় ওপরে উঠে এসেছে । 2018 সালের পর থেকে কমনওয়েলথ গেমসের পরে আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন । তার জন্য বেছে বেছে টুর্নামেন্ট খেলেছি ৷ সফল হওয়ার চেষ্টা করেছি যাতে পয়েন্ট বেশি পাওয়া যায় ৷"
অলিম্পিকসেও ঠিক একইভাবে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়ার কথা বললেন সৌম্যদীপ ৷ তিনি বলেন, "সুতীর্থার সামনে অলিম্পিকসে অন্তত দু'জন উপরের সারির খেলোয়াড়কে হারানোর লক্ষ্য দিয়েছি । তাহলে প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল বা কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া সম্ভব হবে । পাশাপাশি অলিম্পিকসের ড্র কেমন পড়ে সেটাও জরুরি । আমি ভাল কিছুর ব্যাপারে আশাবাদী ।" পরিসংখ্যান বলছে সুতীর্থা ইউরোপের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে বেশি সফল । তবে চিন, চিনা তাইপে, জাপান, কোরিয়ার খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধেও লড়াই হয় । বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চান সৌম্যদীপ । বললেন, "মানসিকভাবে আমি ওকে বেশি চাপ না নেওয়ার কথা বলেছি । প্রথম অলিম্পিকসে খেলার একটা উত্তেজনা থাকে । সেই প্রত্যাশার চাপ যদি সামলাতে পারে তাহলে ভাল কিছু হতেই পারে ।"
আরও পড়ুন : Deepika Kumari : বাঁশের তির-ধনুকে শুরু, অলিম্পিকস পদক পাখির চোখ অপ্রতিরোধ্য দীপিকার
ছাত্রীর প্রশংসা করে সৌম্যদীপ বলেছেন, "ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের সুতীর্থা ভাল সামলায় । ওরা চিনের খেলোয়াড়দের একটু আলাদা । কিন্তু গত কয়েকবছরে বিশ্বের আট, 16 নম্বর খেলোয়াড়কে হারাতে দেখেছি । এই সাফল্যগুলো আত্মবিশ্বাস বাড়ায় । চাইব সেই বিশ্বাস যেন নির্দিষ্ট দিনে বজায় থাকে ৷"
ছোট ছোট লক্ষ্য পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলার কথা জানেন সুতীর্থা । আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্ট খেললেও অলিম্পিকস সবসময় আলাদা । সেখানে নিজের মনসংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে সেরাটা দেওয়ার দরকার । গত কয়েক বছরে কোচেদের তৈরি করা রূপরেখা অনুসরণ করে ক্রমতালিকায় পাঁচশো থেকে প্রথম একশোতে ঢুকে পড়েছেন । ক্রমতালিকায় বিশ্বের প্রথম কুড়িতে ঢুকে পড়াই লক্ষ্য তাঁর । ইউরোপের খেলোয়াড়দের সাবলীল তিনি । চিন, চিনা তাইপে, কোরিয়া, জাপানের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে লড়াই করে ম্যাচ বার করতে হয় সুতীর্থাকে । যদিও এই পরিসংখ্যান অলিম্পিকসের আগে মাথায় রাখছেন না নৈহাটির মেয়েটি । বলেছেন, "অলিম্পিকসের আসরে সেরা বাছাই করা খেলোয়াড়রা আসবেন । তাই প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ । হালকাভাবে নেওয়ার জায়গা নেই । এবারের দল যথেষ্ট শক্তিশালী । সবকিছু ঠিকঠাক চললে পদক আসতেই পারে ।"
আরও পড়ুন : Dutee Chand : রিও অলিম্পিকসে পারিনি, টোকিয়োতে করে দেখাব ; আত্মবিশ্বাসী দ্যুতি
প্রস্তুতির মধ্যেই মনোবিদের কাছে মানসিক স্থিরতার জন্য যাচ্ছেন । দু'বেলা অনুশীলনে ফিটনেস ট্রেনিং, ম্যাচ সিচুয়েশন ঝালিয়ে নিচ্ছেন । নির্দিষ্ট ডায়েট মেনে ওজন ঝরিয়েছেন সুতীর্থা । "আমি বোর্ডের উপর খেলতে পছন্দ করি । ব্যাকহ্যান্ড আমার শক্তিশালী অস্ত্র", আত্মবিশ্বাসী শোনায় জাতীয় চ্যাম্পিয়নের গলা ।
অলিম্পিয়ান হতে চলা ছাত্রীকে নিয়ে আশার কথা সৌম্যদীপের গলায় । বলছিলেন, "সুতীর্থার মধ্যে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে । শুধু নির্দিষ্ট দিনে নিজের ওপর বিশ্বাসটা রাখতে হবে ।" অর্জুন পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন । তবে আপাতত সবকিছু ছাপিয়ে অলিম্পিকসের মঞ্চকে চাঁদমারি করছেন সুতীর্থা মুখোপাধ্যায় ।