কলকাতা, 24 মে : লকডাউন ৷ তাই মা তার ছেলেকে পেয়েছে নতুনভাবে। সেখানে নেই পুলিশের উর্দি, তদন্তের স্বার্থে বিশ্লেষনী মন অনেক দূরে । এক্ষেত্রে মা এবং ছেলের সেতু একটি রাগবি বল। সঙ্গীতা বেরা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর । একই সঙ্গে ভারতীয় রাগবি দলের সদস্য ৷
আলিপুর বর্ডিগার্ড লাইনের কোয়ার্টার সঙ্গীতার ঠিকানা । লকডাউনে ঘরবন্দী দশায় বেরা পরিবারের গোয়েন্দা গিন্নি এখন ডিউটি, প্র্যাকটিসের ঝক্কি সামলে অনেক বেশি করে পরিবারকে সময় দিতে পারছেন। ফলে সাড়ে চার বছরের ছেলে রিয়ান ব্যস্ত মাকে নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছে । আর সঙ্গীতা ছেলের দুষ্টুমির মধ্যে নতুনভাবে মাতৃত্বকে উপভোগ করছেন ।
এই গল্পটা শুধুমাত্র মা এবং ছেলের ফিরে পাওয়ার গল্প নয়। এই গল্পটা ব্যস্ততম ক্রীড়াবিদ মায়ের লড়াইয়ের আখ্যান। যেখানে স্বপ্ন রয়েছে, রয়েছে পরিবার, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের কথা ।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাবইনস্পেক্টর সঙ্গীতা বেরা ৷ যার মুকুটে রয়েছে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ব্রোঞ্জ পদক । চোখে রয়েছে এশিয়া সেরা হওয়ার স্বপ্ন । লকডাউন ক্রীড়াবিদ গোয়েন্দার অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটালেও তা বন্ধ করতে পারেনি। সূচি অনুসারে এই সময় ভারতীয় দলের এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কোরোনা আপাতত সেই সূচি ঘেটে দিয়েছে । ফলে নতুন দিনক্ষণ জানা নেই। তবে বসে থাকার উপায় নেই সঙ্গীতার। ভারতীয় দলের দক্ষিণ আফ্রিকান কোচেদের বেঁধে দেওয়া শিডিউল মেনে সবকিছু করতে হচ্ছে।
প্রথমে আলিপুর বর্ডিগার্ড লাইনের মাঠে অনুশীলন করছিলেন। কিন্তু সেখানে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ধরা পড়ায় ব্যারাকের ভিতর অন্য একটি কৃত্রিম ঘাসের মাঠে অনুশীলন করছেন সঙ্গীতা । সামাজিক দূরত্ব মেনে সবকিছু করতে হচ্ছে । তাই ভোর পৌনে চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে অনুশীলন সারছেন তিনি ।
গোয়েন্দা বিভাগের চাকরি মানেই তদন্ত সমাধানের ব্যস্ততা । কিন্তু ক্রীড়াবিদ গোয়েন্দা বলছেন, "পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা স্যার, যুগ্ম কমিশনার মুরলীধরনস্যার এবং বড়বাবু বিনয় চক্রবর্তীর সাহায্যে আমি শুধু খেলায় মনসংযোগ করতে পারছি । বিভাগের বিপুল কাজের ফাঁকে অনুশীলন এবং প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় সময় বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন ওঁরা । সেই কারণেই আমি লকডাউনের মাঝে পুলিশি ডিউটি কিংবা আমফানের ঝাপটা সামলানোর চাপ সরিয়ে অনুশীলন করতে পারছি । এমন সহানুভূতিশীল, সাহায্যকারী ডিপার্টমেন্ট পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ।" তবে এই দুঃসময়ে লড়াই করে চলা ডাক্তার নার্সদের কুর্নিশ জানাচ্ছেন । তাদের কুর্নিশ জানাতে প্রতিযোগিতার মঞ্চে দেশের পতাকা সবার ওপরে তুলে ধরতে চান তিনি ।
গার্ডেনরিচের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের ভারতীয় রাগবি দলের সদস্য হওয়ার পিছনের গল্পটা একটু অন্যরকম। কোচ তপন ঘোষের অধীনে অ্যাথলিট হওয়ার জন্য ঘাম ঝরানো সঙ্গীতা ছিলেন রাজ্য পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীর দৌড়বিদ । 2014 সালের রাজ্য অ্যাথলেটিক্স মিটে একশো এবং দু‘শো মিটারে পদক রয়েছে । এইসময় সঙ্গীতা অ্যাথলেটিক্স এবং রাগবি দুটোই একসঙ্গে খেলতেন । পরে শুধুমাত্র রাগবিকে বেছে নেন।
কীভাবে হল এই পরিবর্তন? সালটা 2010 । সাই ক্যাম্পাসে অনুশীলন করছিলেন সঙ্গীতা। সেইসময় রাগবি দল তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়ে খেলোয়াড় খুঁজতে সেখানে এসেছিলেন জাঙ্গল ক্রো দলের প্রাণপুরুষ পল ওয়ালশ । ব্রিটিশ হাইকমিশনের উচ্চ পদস্থ কর্মীটি এই রাজ্যে রাগবি খেলাটি জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেদিন তার চোখে লেগেছিল সঙ্গীতার দৌড়ের গতি। তারপর কোচ তপন ঘোষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সঙ্গীতাকে তিনি রাগবি খেলাটির সঙ্গে পরিচিত করান ।
অনেকেই জানেন না বাংলার রাগবি দলের জাতীয় পর্যায়ের সাফল্য নজরকাড়া । 2010 সালে প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে খেতাব জিতেছিল বাংলা। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পুণেকে হারানো সেইসময় মোটেও সহজ ছিল না। ওই পারফরম্যান্সের রেশ ধরে সঙ্গীতা ভারতীয় দলে জায়গা করে নেন । তারপর থেকে শুধুই এগিয়ে চলা। ম্যানিলাতে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ এসেছে, ফিলিপিন্সকে হারিয়ে। এবার মালয়েশিয়াতে ফের এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার কথা থাকলেও তা কোরোনার জেরে হয়নি।
অলিম্পিকে ভারতীয় দলকে যোগ্যতা অর্জন করানোর স্বপ্ন দেখেন বাঙালি মেয়েটি । তার আগে ধাপে ধাপে এশিয়া সেরা হওয়ার স্বপ্ন । চিনকে হারিয়ে শীর্ষে ওঠার পরিকল্পনা থাকলেও তার জন্য তাড়াহুড়ো নয় । "আমরা এই দেশে রাগবি খেলার প্রথম প্রজন্ম । নতুনদের শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর কর্তব্য রয়েছে । সেই কারণে নিয়মিত ভালো পারফরম্যান্স জরুরি । যাতে নতুনরা উদ্বুদ্ধ হয় ৷ " জানিয়েছেন সঙ্গীতা ।
স্বামী রামকৃষ্ণ পারিদা একজন প্রাক্তন রাগবি খেলোয়াড় । বর্তমানে স্পোর্টস ম্যাসিওর । সঙ্গীতার যাত্রাপথে তিনিও অন্যতম অনুপ্রেরক । রাগবি খেলাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় । সেখানকার রাগবি লিগের খুঁটিনাটি খবর রাখলেও নিউজিল্যান্ডের অল ব্ল্যাকসদের পছন্দ সঙ্গীতা বেরার ।