হায়দরাবাদ, 15 অগস্ট: বড়ে মিঞা তো বড়ে মিঞা, ছোটে মিঞা শুভান আল্লাহ... ৷ মহম্মদ আজম, মহম্মদ নইম, ফারিদ, হাবিব, আকবর এবং জাফর ৷ ফুটবলে মাঠ মাতিয়েছেন নিজামের শহরের ছয় ভাই-ই ৷ তার মধ্যে চার ভাই কলকাতা ময়দানে খেললেও কলকাতা এখনও একডাকে চেনে আকবর-হাবিবকে ৷ বড়ে মিঞা-ছোটে মিঞার দাপট এখনও টাটকা ময়দানে ৷
ফুটবল জীবনের প্রত্যেক মরশুমেই ধারাবাহিকভাবে বিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছেন মহম্মদ আকবর । তিনি মাঠে থাকলেই তটস্থ থাকতেন বিপক্ষের ডিফেন্ডাররা । ফুটবলবোদ্ধারা অবশ্য বলেন, হাবিব ছিলেন বলেই আকবর ‘বাদশা’ হয়েছেন ৷ পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে, দাদা পাশে না-থাকলেও বিপক্ষের জালে বল জড়ানোর কাজটা কোনও জড়তা ছাড়াই করে গিয়েছেন তিনি ৷ যদিও, ময়দানের সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকারদের মধ্যে অন্যতম ছোটে মিঞা বিশ্বাস করেন, বড়ে মিঞা পেছনে থাকলেই তিনি তেকাঠির কাছে আরও সহজে পৌঁছে যেতেন ।
‘‘আমাদের রক্তে খেলা, ছোট থেকেই দেখছি দাদারা ফুটবল খেলছে ৷ ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমিও ফুটবলের দিকেই আকৃষ্ট হই ৷’’ বলেন আকবর ৷ কিন্তু শুধুই কি প্যাশন, ফুটবলের প্রতি প্রেম ? হায়দরাবাদের বাড়িতে বসে ময়দানের ছোটে মিঞা বলেন, ‘‘আমাদের সময় ভাল খেললেই চাকরি পাওয়া যেত ৷ দাদাকে দেখেছি, ভাল খেলার সুবাদেই চাকরি করছে ৷ 66-তে হাবিবদা অন্ধ্রপ্রদেশের হয়ে সন্তোষ ট্রফি জিতল ৷ ইস্টবেঙ্গলের জ্যোতিষ গুহ ওকে কলকাতা যাওয়ার অফার দিল ৷ তার আগে মেজ ভাই মইন মহমেডানে খেলে এসেছে ৷ ওদের থেকে ময়দানের গল্প শুনছি ৷ ফলে আমারও টান বাড়তে লাগল ৷’’
কিন্তু ময়দানে নেমেই তো দাদার মুখোমুখি, জুটি তো পরে বেঁধেছেন ৷ অসুবিধা হয়নি ? ‘‘আমরা ফুটবলার ৷ যে দলের জার্সি গায়ে চাপাই সেই দলের হয়ে যাই ৷ মাঠে নামলে 90 মিনিট ও ভুলে যেত আমি ওর ভাই, আমিও তেমনি ভুলে যেতাম ও আমার দাদা ৷ সুভাষ (ভৌমিক), বিদেশ (বোস), সুধীরদের (কর্মকার) যেমন ট্যাকল করত, ভুল করলে গালাগাল দিত (মাঠে কোনও ভুল করলেই হাবিবের রণমূর্তি দেখতেন সতীর্থরা) তেমনই আমারও প্রাপ্য ছিল ৷’’, অকপট হাবিবের সহোদর ৷ যদিও আকবরের কথায়, ‘‘সামনে না, দাদা পেছনে থাকলে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যেত ৷’’
সালটা 1976 ৷ মোহনবাগানে একসঙ্গে এসেছেন দুই ভাই । বড়ে মিঞা-ছোটে মিঞা জাদুতে মুগ্ধ আপামর কলকাতা ৷ ময়দানে খেলা যে কোনও খেলোয়াড়ের কাছে ডার্বি ম্যাচ একস্ট্রা স্পেশাল । দাদার কাছে সেই ম্যাচের গল্প শুনেই তো কলকাতায় পা রেখেছিলেন আকবর । মহামেডানে ফুটবল জীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে খেলেছেন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলেও । কিন্তু তাঁর কাছে সেরা ম্য়াচ কোনটা ? 1976 সালের ডার্বি ? যাতে মাত্র 13 সেকেন্ডে ইস্টবেঙ্গলের জালে বল জড়িয়েছিলেন তিনি । যেই রেকর্ড দীর্ঘ 45 বছর ধরে অটুট ৷ উলগানাথনের ক্রস থেকে গোল করলেও বল তৈরি করেছিলেন তাঁর দাদা, হাবিব । তাঁর গোলেই বেশ কয়েকবছর পর ডার্বি জয়ের স্বাদ পেয়েছিল সবুজ-মেরুন ।
আরও পড়ুন: জীবনের ময়দান থেকে অবসরে হাবিব, প্রয়াত ভারতীয় ফুটবলের 'বড়ে মিঞা'
ওই বছর তাঁদের দাপটেই দীর্ঘদিন পর কলকাতা লিগ জিতেছে মোহনবাগান । ফলে গঙ্গাপাড়ের তাঁবুতে সেবছর উৎসবের আমেজ । অগস্ট মাস, কলকাতাজুড়ে বৃষ্টির দাপট চলছে । তার মধ্য়েই তৎকালীন সচিব ধীরেন দে জানান, কসমসকে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে । সবকিছু ঠিক থাকলে আর একমাসের মধ্যে পেলের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে ।
স্মৃতিচারণা করতে করতে ছোটে মিঞা ফিরে গিয়েছেন পাঁচ দশক আগে । আকবর বলেন, "অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । 24 সেপ্টেম্বর ওই ম্যাচের কয়েকদিন আগে পেলে-সহ কসমস দল কলকাতায় এসে গিয়েছে । ওদের রাখা হয়েছে গ্র্যান্ডে । আর অন্যদিকে আমরা জোরকদমে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি । হোক না প্রস্তুতি ম্যাচ, বিশ্বসেরাদের বিরুদ্ধে তো নিজেদের সেরাটাই দিতে হবে । কিন্তু তাতে বাধ সাধল বৃষ্টি । ম্যাচে তিনদিন আগে থেকে লাগাতার বৃষ্টিতে ইডেন গার্ডেন্সে তখন এক হাঁটু কাদা । মাঠের অবস্থা দেখে বেঁকে বসলেন কসমসের অফিসিয়ালরা ।"
যদিও ধীরেন দে’র অনুরোধেই শেষ পর্যন্ত মাঠে নামেন পেলে । কিন্তু কসমসকে রুখে দেওয়া। এর রহস্য কী ? "আমরা সত্যিই প্রথমে ভেবেছিলাম ভালো খেললেও পাঁচ গোল খাব । তাই পেলের বিরুদ্ধে খেলাটা উপভোগ করা যাক । কিন্তু মাঠে নেমেই সব ভুলে গেলাম । পেলে, কসমস, প্রদর্শনী ম্যাচ সব কিছুই । আমাদের বলা হয়েছিল ওদের কাউকে জোরে ট্যাকল করা যাবে না । আর দাদা (পড়ুন হাবিব) নেমেই পেলেকে 'টাফ' ট্যাকল করে বসল ।" ফুটবল সম্রাট কটমট করে তাকাতেই দাদার সেই বিখ্যাত সংলাপ, 'ইউ পেলে, আই হাবিব'।
আরও পড়ুন: কলকাতা ডার্বিতে 13 সেকেন্ডের গোলের রহস্য ফাঁস করলেন আকবর