কলকাতা, 19 নভেম্বর: ফিফা বিশ্বকাপ (FIFA World Cup 2022), আর সেই টুর্নামেন্টের বলে নতুনত্ব থাকবে না, তা হয় না ৷ সেই শুরুর দিন থেকে ফিফা বিশ্বকাপের বলে বৈচিত্র্য দেখা গেছে ৷ 1930 সাল থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের 92 বছরের ইতিহাসে (History of Official World Cup Match Balls) এবছরের ‘আল রিহলা’ 20 নম্বর ফুটবল ৷ ‘আল রিহলা’ আরবিয়ান শব্দ ৷ যার ইংরেজি তরজমা করলে অর্থ ‘দ্য জার্নি’ ৷ বাংলায় ‘সফর’ ৷ বিশ্বকাপের 92 বছরের সফরকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে প্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যাডিডাস ৷
এই ‘আল রিহলা’র আরও একটি বৈশিষ্ট্য, এর গতি ৷ 2018 সালের টেলস্টার-18 এর থেকেও বেশি জোরে হাওয়ার ট্রাভেল করবে এই ফুটবলটি ৷ আর এই ফুটবলের গঠন শৈলির মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে ৷ বলের কোর অর্থাৎ, ভিতরের ব্লাডার এবং বাইরের চামড়ার বিশেষত্ব রয়েছে ৷ বলের ভিতরের বেস এতটাই সঠিক যে, খেলোয়াড়ের পাসও সঠিক হতে বাধ্য ৷ বলের আকৃতি সহজে বদলাবে না ৷ তীব্র হাওয়ার মধ্যেও মশ্রিণ গতিতে এগিয়ে যাবে ৷ বলের ‘পলিউরেথিন’ চামড়ায় রয়েছে সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম কাজ ৷ আর 20টি প্যানেল জুড়ে বলটি তৈরি করা হয়েছে ৷ যা হাওয়ার বলের ভারসাম্য বজায় রাখবে ৷
‘আল রিহলা’র রং তৈরি করা হয়েছে কাতারের স্থাপত্য, সংস্কৃতি এবং জাতীয় পতাকাকে মাথায় রেখে ৷ বলে যে রং ব্যবহার করা হয়েছে, তাও পুরোপুরি জল নিরোধক ৷ এ তো গেল ‘আল রিহলা’র বাইরের বৈশিষ্ট্য ৷ 2022 কাতার বিশ্বকাপের বলও টেলস্টার-18 এর মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ৷
‘আল রিহলা’র প্রযুক্তি
বলের ভিতরে ‘ইউনিট মোশন সেন্সর’ রয়েছে ৷ যা বলের কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে ৷ পাশাপাশি, বলের ভিতরের আয়তনে বদল আসলে তাও পরিমাপ করবে ৷ আল রিহলা’র ভিতরের ‘ইউনিট মোশন সেন্সরে’র সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করা যাবে ৷ বলের কোন পজিশনে খেলোয়াড় কিক করছে, কোনদিকে বল যাচ্ছে, তার গতি সবই 500 হার্ৎজ প্রতি সেকেন্ডে 500 ফ্রেম রেকর্ড করবে ৷ স্টেডিয়ামের ছাদে 12টি ক্যামেরা থাকবে ৷ যে ক্যামেরাগুলি বলের অবস্থান ট্র্যাক করবে ৷ সেই সঙ্গে মাঠের 22 জন ফুটবলারকে প্রতি সেকেন্ডে 50 বার ফ্রেমবন্দি করবে ওই 12টি ক্যামেরা ৷ খেলোয়াড় বল রিসিভ করলে বা শট নিলে, ভিতরে থাকা ‘ইউনিট মোশন সেন্সর’ বা আইএমইউ তা ট্র্যাক করবে ৷ আর সেই সব তথ্য ওয়াই-ফাই এর মাধ্যমে ভিডিয়ো অপারেশন রুমের সঙ্গে কানেক্টেড থাকবে ৷ যেখান থেকে ম্যাচ রেফারিকে মাঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা হবে ৷
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপ মঞ্চে অঘটনের মুখোমুখি যেসব বিশ্বজয়ীরা
তবে, ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই আধুনিকতার ছোঁয়া এসেছে 2018 সাল থেকে ৷ তার আগে এত প্রযুক্তির ব্যবহার অন্তত ফুটবল তৈরির ক্ষেত্রে করেনি ফিফা ৷ সময় যত গড়িয়েছে বিশ্বকাপে ব্যবহার হওয়া বলে আধুনিকতার ছাপ লেগেছে ৷
‘টি-মডেল’ (1930 বিশ্বকাপ)
কিন্তু, শুরুর দিনে অর্থাৎ, 1930 সালে প্রথমবার ফিফা বিশ্বকাপে যে বল ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি ‘টি-মডেল’ (T model) ৷ প্রাক-অ্যাডিডাস যুগের সেই বলে ইংরেজির ‘টি’ আকৃতির প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছিল ৷ আর সেই বল তৈরি করেছিল ‘ওয়েম্বলি’ নামে একটি সংস্থা ৷
‘ফেডেরাল 102’ (1934 বিশ্বকাপ)
13টি পলিগোনাল প্যানেলকে হাতের সেলাইয়ে জুড়ে এই বল তৈরি করা হয়েছিল ৷ শক্ত চামড়ার বদলে খয়রি রংয়ের তুলো ব্যবহার করা হয়েছিল ৷ যাতে খেলোয়াড়রা সহজে বলে হেড দিতে পারেন ৷
‘দ্য অ্যালেন বল’ (1938 বিশ্বকাপ)
ফেডেরাল 102 এর থেকে দ্য অ্যালেন বলের ফারাক ছিল কেবল রং ৷ বাকি প্রায় সবই এক ছিল ৷
‘সুপার বল’ (1950 বিশ্বকাপ)
1950 সালের ‘সুপার বল’ তৈরি করেছিল আয়োজক ব্রাজিল ৷ প্রথমবার বিশ্বকাপের বলে কোনও চামড়ার পট্টি ব্যবহার করা হয়নি ৷ সরাসরি 12টি প্যানেলকে সেলাই করে ফুটবল তৈরি করা হয়েছিল ৷
‘সুইস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন’ (1954 বিশ্বকাপ)
সুইস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন বলের বিশেষত্ব ছিল এর উজ্জ্বল রং ৷ যা খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও সহজে দেখা যেত ৷ হলদে উজ্জ্বল রংয়ের সেই ফুটবল 18টি প্যানেল দিয়ে তৈরি ৷
‘ক্র্যাক’ (1962 বিশ্বকাপ)
18টি অবিন্যস্ত পলিগোনাল প্যানেল দিয়ে এই ‘ক্র্যাক’ ফুটবলটি তৈরি করা হয়েছে ৷ আর প্রথমবার ফুটবল তৈরির ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়েছিল, হাওয়ায় তার আকৃতি এবং দীর্ঘস্থায়িত্বের বিষয়ে ৷
টেলস্টার ডুরলাস্ট (1970-74 বিশ্বকাপ)
বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবার সাদা ও কালোর সংমিশ্রণে তৈরি বল নিয়ে আসে ফিফা ৷ আর সেটা তৈরি করা হয়েছিল, কারণ প্রথবার টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখানো হচ্ছিল ৷ আর বল সহজে দৃশ্যমান হওয়ার জন্য এই টেলস্টার ডুরলাস্ট নিয়ে আসে অ্যাডিডাস ৷
ট্যাঙ্গো ডুরলাস্ট (1978-82 বিশ্বকাপ)
ফিফার বিশ্বকাপ বলে এখান থেকেই বৈচিত্র্য় আসতে শুরু করে ৷ সাদা কালোর মধ্যে যেখানে 20টি প্যানেলে কালো ত্রিকোণ আকৃতি তৈরি করা হয় ৷ যা 20টি প্যানেলের সাদা রঙের উপরে আঁকা ছিল ৷ আর সেই ত্রিকোণগুলি এমনভাবে তা জোড়া ছিল, যা নিজের মধ্যেই একটি সুন্দর আকৃতি গঠন করেছিল ৷ আর ফুটবলের আকৃতিতে ট্যাঙ্গো ডুরলাস্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ৷
এর পরবর্তী সময়ে 1886 ও 1990 সালে অ্যাডিডাস সেই সাদার উপর কালো ত্রিকোণের মধ্যেই নানান শিল্পকলা তুলে ধরে ৷ যেখানে আসল চামড়ার বদলে সিন্থেটিক ব্যবহার করা হয় ৷ ফলে বলের ওজন হালকা হয়ে যায় ৷ 1986 সালের বলের নাম দেওয়া হয় আজটেকা এবং 1990 বিশ্বকাপে ‘এটরাসকো ইউনিকো’ ৷ 1994 সালে ‘অ্যাডিডাস কোয়েস্ত্রা’ ৷ 1998 সালে প্রথমবার সাদাকালোর বাইরে অন্য রং আসে ফুটবলে ৷ তাও তিন রকমের রং ব্যবহার করা হয় ৷ নাম রাখা হয় ‘অ্যাডিডাস ট্রাইকালার’ ৷
2002 বিশ্বকাপে ফিফা বিশ্বকাপের বলে আসে আধুনিকতার ছোঁয়া ৷ এখান থেকেই শুরু হয় সাহসি রূপদানের চেষ্টা ৷ 2002 বিশ্বকাপের বলে নামকরণ করা হয়, ‘ফেভারনোভা’ ৷ 2006 বিশ্বকাপে মাত্র 14টি ভিন্ন আকৃতির প্যানেল দিয়ে অ্যাডিডাস নিয়ে আসে ‘টিমজিয়েস্ট’ ৷ আর 2010 জার্মান বিশ্বকাপের বল ‘জাবুলানি’তে আসে নানান রঙের ছোঁয়া ৷ সেই সঙ্গে ‘থ্রি-ডি’ প্যানেল ৷ চিত্তকর্ষক সেই ফুটবলে মজেছিল বিশ্ব ৷ 2014 ব্রাজিল বিশ্বকাপে বলের নাম নির্ধারণ হয়েছিল সাধারণের ভোটে ৷ যেখানে সবচেয়ে বেশি ভোট পায় ‘ব্রাজুকা’ ৷ যার অর্থ, ব্রাজিলিয়ান আদপকায়দার জীবনধারণ ৷ অর্থাৎ, ফুটবলের ছন্দে জীবনধারণ ৷ আর সেখানে ব্যবহার হওয়া রং ছিল সৌভাগ্যের প্রতীক ৷ যা ব্রাজিলের ‘বাহিয়া ব্যান্ড’কে উপস্থাপন করে ৷
আর 2018 রাশিয়া বিশ্বকাপে আধুনিক রূপে ‘টেলস্টার’কে ফিরিয়ে আনে ফিফা ৷ 1970-74 সালের ‘টেলস্টার ডুরলাস্ট’কে স্মরণ করে তৈরি করা হয় ‘টেলস্টার-18’ ৷ আর প্রথম কোনও বল তৈরি করা হয় ৷ যার বডি পুনর্ব্যবহারযোগ্য ৷ আর প্রথমবার প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আসা হয় ফুটবলে ৷ যেখানে ‘এনএফসি’ চিপ ব্যবহার করা হয় ৷ যা রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যালের মাধ্যমে বলের অবস্থান ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য দেয় ৷