কলকাতা, 20 মার্চ: "এটিকে মোহনবাগান শুনতে ভালো লাগে না ৷ তাই সঞ্জীবকে বলেছিলাম নাম পালটাতে ৷ শুধু মোহনবাগানই ভালো (Mamata Banerjee says ATK does not go with Mohun Bagan) ৷" আবারও একটা মাস্টার স্ট্রোক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৷ আর এভাবেই মোহনবাগানের সমর্থকদের আবেগ ছুঁলেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ আইএসএল জয়ী মোহনবাগানের ক্লাব তাঁবুতে তাঁর এই মন্তব্যের প্রভাব কতটা সুদূর প্রসারী তা এখন না হলেও, আগামী একবছরে সেটা বোঝা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ পাশাপাশি, সবুজ-মেরুন নিয়ে তাঁর পরিবারিক যোগের প্রসঙ্গও তুলে ধরলেন তিনি ৷ এদিন মোহনবাগান ক্লাবের উন্নয়নে আরও 50 লক্ষ টাকা সরকারের তরফে ঘোষণা করেছেন তিনি ৷
আজ মোহনবাগান তাঁবুতে ভারতসেরা জুয়ান ফেরান্দোর দলকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে ৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ৷ ফুটবলারদের উত্তরীয় বা ফুল তুলে দিলেন ৷ পাশাপাশি তিনি নিজেও যে মোহনবাগানের সঙ্গে সবসময় রয়েছেন, সেই বার্তাটা সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন ৷ বুঝিয়ে দিলেন ক্লাবের ঐতিহ্য এবং আবেগের কদর তিনিও করেন ৷ আর তাই নিজের উদ্যোগে এটিকে নাম সরিয়েছেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে বলে ৷ মমতা বলেন, "আমি সঞ্জীবকে বলেছিলাম, এটিকে কেন ? এটিকে মোহনবাগান শুনতে ভালো লাগে না ৷ শুধু মোহনবাগানই ভালো ৷"
মমতার এই মন্তব্যের আদ্যপান্তটাই চতুর রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল ৷ এখানে শুধু আবেগ নয় ৷ কোথাও লক্ষ লক্ষ মোহনবাগান সমর্থককে নিজের দিকে টানার কৌশল ছিল ‘এটিকে শুনতে ভালো লাগে না’ কথাটার মধ্যে ৷ আর সেটা যে তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছেন, তার প্রমাণ মোহনবাগান তাঁবুতে উপস্থিত কয়েক হাজার সমর্থকের উল্লাসে ধ্বনি ৷ সঙ্গে বাড়তি যোগ, ক্লাবকে 50 লক্ষ টাকার অনুদান ঘোষণা সরকারের তরফে ৷ ক্লাব ও ফুটবলারদের উন্নতিতে সেই টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মমতা ৷
তবে, এটাই প্রথম নয় ৷ মমতার ফুটবলের আবেগকে নিজের ভোট বাক্সে ব্যবহারের নজির আগেও দেখে বাংলার রাজনৈতিক মহল ৷ শুরুটা করেছিলেন 2020 সালে ৷ যখন এটিকে অর্থাৎ, সঞ্জীব গোয়ঙ্কার স্পোর্টস কোম্পানি মোহনবাগানের 80 শতাংশ ফুটবল রাইটস কিনে নেয় ৷ সেই সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বিনিয়োগকারী না পেয়ে আইএসএল খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি ৷ তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্ন থেকে শ্রী সিমেন্ট সংস্থাকে ইস্টবেঙ্গলের বিনিয়োগকারী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন ৷ তার একবছর আগে, 2019 লোকসভায় তৃণমূলের আসন 36 থেকে 22-এ নেমে গিয়েছিল ৷ একাংশ রাজনীতিবিদ এবং বিরোধীরা সেই ঘোষণায় মমতার ভোট রাজনীতি দেখেছিলেন ৷ আর সেটা যে খুব একটা অমূলক ছিল না ৷ তা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি রাজনৈতিক মহলের একাংশের ৷
এখানেই শেষ নয়, একবছরের মধ্যেই ইস্টবেঙ্গল এবং শ্রী সিমেন্টের বিবাদ শুরু হয় ক্লাবের মালিকানা নিয়ে ৷ শ্রী সিমেন্ট আর ইস্টবেঙ্গলে বিনিয়োগ করবে না, এমনটা প্রায় চূড়ান্ত ৷ এক বছরেই ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল থেকে বিদায় হচ্ছিল ৷ কিন্তু, সেখানে আবারও ত্রাতার ভূমিকায় নামেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ আবারও নবান্ন থেকে তাঁর ঘোষণা, নিজেদের মধ্যে কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নিক ক্লাব এবং বিনিয়োগকারীরা ৷ লগ্নি প্রত্যাহারের কথা তিনি শুনবেন না ৷ একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফের ইস্টবেঙ্গলে বিনিয়োগ করে শ্রী সিমেন্ট ৷
আরও পড়ুন: আগামী মরশুমে নাবিক ফেরান্দোই, সোমবার বাগান তাঁবুতে মুখ্যমন্ত্রী
কিন্তু, সেই বিতর্ক থামেনি ৷ ক্লাবের মালিকানা ও চুক্তি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে ৷ 2021-22 আইএলএল এর মরশুম শেষে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে শ্রী সিমেন্ট ৷ ফের সংকটে পড়ে ইস্টবেঙ্গল ৷ আর তৃতীয়বারেও ত্রাতা সেই মুখ্যমন্ত্রী ৷ নানান বিনিয়োগকারীর নাম ভেসে উঠলেও, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নবান্নের 14 তলার ঘর থেকে হয়েছিল ৷ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ইস্টবেঙ্গলের নতুন বিনিয়োগকারী হবে ইমামি সংস্থা ৷ আবারও লাল-হলুদ ক্লাবের মান রক্ষা করেছিলেন তিনি ৷ সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের লক্ষ লক্ষ সমর্থককে বিশ্বাস করিয়েছিলেন, তিনি আছেন ৷
কলকাতা ময়দানের আরেক প্রধান মহামেডান স্পোর্টিংয়ের ক্ষেত্রেও গল্পটা প্রায় এক ৷ গতবছর মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব থেকে মুখ্যমন্ত্রী ক্লাবের পরিকাঠামো উন্নয়নে 50 লক্ষ টাকার অনুদান ঘোষণা করেছিলেন সরকারের তরফে ৷ সেই সময় ক্লাবের জেলারেল সেক্রেটারি ছিলেন দানিশ ইকবাল ৷ বর্তমানে তিনি এক্সিকিউটিভ মেম্বার ৷ তিনি জানান, সরকারের সেই আর্থিক সাহায্যে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে দোতলা বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে ৷ এমনকি তার আগেও সরকারের তরফে মাঠের উন্নতি ও পরিচর্যার জন্যও 47 লক্ষ টাকার সাহায্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷
মহামেডান স্পোর্টিংয়ে মমতার এই অবদান সেই সময় ছিল, যখন সংখ্যালঘুদের একাংশ তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল ৷ তাই বাংলার ফুটবলের উন্নয়ন এবং সমর্থকদের আবেগকে কীভাবে জিততে হয়, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে ভালো কেউ বোঝেনি ৷ তা সে রাজনীতির ময়দানে হোক বা খেলার ৷ বাংলার আবেগ জেতার প্রশ্নে, তিনিই সেরা ৷ তা আরও একবার প্রমাণ করলেন মমতা ৷