হায়দরাবাদ: ভারতে আয়োজিত ক্রিকেট বিশ্বকাপ 2023-এর শুরুটা যতটা না আনন্দের সঙ্গে হয়েছিল ৷ শেষটা হয়েছিল ততটাই বেদনাদায়ক ৷ ঘরের মাঠে ফাইনালে ভারতের জয়ে উচ্চাকাঙ্খায় ছিল সকলেই ৷ 10 বছরের আইসিসির কোনও ট্রফি না জেতার আক্ষেপ ভুলিয়ে দেওয়ার স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন ভারতীয় দলের দুই স্তম্ভ অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি ৷ সঙ্গে অবশ্যই ছিলেন শুভমন গিল, শ্রেয়স আইয়ার, কেএল রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজা, মহম্মদ শামি, জসপ্রীত বুমরা, কুলদীপ যাদবরা ৷ কিন্তু, ফাইনালের দিন সেই বিশ্বজয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সামনে ৷ 2023 সালের শেষে ফিরে দেখা সেই বেদনাদায়ক দিন ৷
হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের তত্ত্ববধানে এশিয়া কাপ থেকেই সেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল ৷ যার নেতৃত্বে ছিলেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা ৷ সঙ্গে সহ-অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া এবং মর্ডান-ডে মাস্টার বিরাট কোহলি ৷ এশিয়া কাপ থেকেই সকলে নিজেদের ফর্ম ও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন ৷ সঙ্গে চোট সারিয়ে দলে ফিরেই সকলকে আশ্বস্থ্য করেছিলেন কেএল রাহুল, শ্রেয়স আইয়ার এবং জসপ্রীত বুমরা ৷ তিন ক্রিকেটারই বড় চোট পেয়েছিলেন ৷ তিনজনকেই অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল ৷ এর পর দীর্ঘ সময়ের রিহ্যাব শেষে দলে ফিরে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ৷ ফলে প্রত্যাশাটা যেন আরও কয়েকধাপ বেড়ে গিয়েছিল দল ও ভারতীয় সমর্থকদের মধ্যে ৷
আর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ হওয়ায় মেন ইন-ব্লু ছিল হট ফেভারিট ৷ লিগ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের মতো বড় দলগুলিকে অনায়াসে হারিয়ে সেই স্বপ্নে বাড়ি উড়ান ভরে ছিলেন রোহিতরা ৷ এমনকি বেশ কয়েকটি ক্লোজ ম্যাচ বোলারদের দাপটে বের করে এনেছিল ভারত ৷ যার মধ্যে অন্যতম ছিল, ইংল্যান্ড এবং সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড ম্যাচ ৷ ভারতীয় পেস ত্রয়ীর সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন বিশ্বের তাবড় ব্যাটাররা ৷ কিন্তু, 19 নভেম্বর রবিবার, আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে হঠাৎই সেই স্বপ্নের মজবুত মনে হওয়া ডানা কমজোর হয়ে পড়ে ৷
রোহিতের অতি-আগ্রাসী ব্যাটিং
একজন অধিনায়ক তাঁর পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে নেতৃত্ব দেন ৷ রোহিত শর্মা টুর্নামেন্টের শুরু থেকে ব্যাট আগ্রাসী ভূমিকা ও রান করে সেই কাজটা সফলভাবে করেছেন ৷ তিনি টুর্নামেন্টের প্রথম দশ ওভারে (401 রান) 135.02 স্ট্রাইক রেট-সহ সর্বোচ্চ রানের মালিক ছিলেন ৷ যা টুর্নামেন্টে যেকোনও ব্যাটারের জন্য সর্বোচ্চ ৷ তাঁর আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল দলকে ইনিংসে দূরন্ত স্টার্ট শুধু দেয়নি, বরং এটি দলের রান গতি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল ৷ যা পরেরদিকে নামা বিরাট কোহলি, শ্রেয়স আইয়ার এবং কেএল রাহুলকে ইনিংস গড়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ম্যাচে সাহায্য করেছে ৷
ব্যাট হাতে রোহিত দলের প্রয়োজনে কঠিন সময়ে ক্রিজে দাঁড়িয়ে থেকে রানও করেছেন ৷ উদাহরণ লখনউয়ের স্লথ পিচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি 101 বলে 87 রান করেছিলেন ৷ যেখানে অন্যান্য ব্যাটাররা উলটোদিক থেকে একের পর এক উইকেট দিয়ে এসেছিলেন ৷ যা সমর্থকদের আশ্বাস জুগিয়ে ছিল যে, টুর্নামেন্টে কঠিন পরিস্থিতিতে এই আগ্রাসী রোহিতই দলের হাল ধরে পার করতে সক্ষম ৷
বিরাট কোহলির অ্যাংকারের ভূমিকা ও মিডল-অর্ডারে যোগ্য সঙ্গত
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যেমন একজন আগ্রাসী ব্যাটার দরকার পড়ে ৷ তেমনি এমন একজনকে দরকার পড়ে, যিনি উলটোদিকে দাঁড়িয়ে দলে এই বিশ্বাসটা জোগাবেন যে, তিনি যতক্ষণ রয়েছেন ততক্ষণ সব নিয়ন্ত্রণে ৷ আর সেই কাজটা পুরো টুুর্নামেন্ট করে এসেছেন বিরাট কোহলি ৷ প্রথম থেকে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত এই কাজটা করে এসেছেন বিরাট ৷ যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টুর্নামেন্টে ভারতের প্রথম ম্যাচ ৷ 200 রান তাড়া করতে নেমে অজি পেসারদের সামনে মাত্র 2 রানে 3 উইকেট হারিয়েছিল ভারত ৷ সেখান থেকে বিরাট কোহলি এবং কেএল রাহুল মাটি আঁকড়া পড়ে থেকে পরিস্থিতি সামলান ৷ বিরাট 85 রানে আউট হয়ে গেলেও, রাহুল 97 রানে অপরাজিত থেকে ম্যাচ জিতিয়ে নিয়ে যান ৷
মিডল-অর্ডারে কেএল রাহুলের পাশাপাশি শ্রেয়স আইয়ার এবং লোয়ার-অর্ডারে রবীন্দ্র জাদেজা প্রতিনিয়ত ভরসা দিয়ে গিয়েছেন ৷ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতিতে কোহলির সঙ্গে ম্যাচ জিতিয়ে ছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা ৷ এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে 2 উইকেট পড়ে যাওয়ার পর, শ্রেয়স আইয়ার বিরাটের সঙ্গে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ করেন ৷
হার্দিকের চোট, শাপে বর
টুর্নামেন্টের শুরুতে ভারতীয় দলের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বোলার হিসেবে খেলছিলেন শার্দূল ঠাকুর এবং হার্দিক পান্ডিয়া ৷ কিন্তু, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচে নিজের বলে ফিল্ডিং করতে গিয়ে পা মুচকে যায় হার্দিকের ৷ যার পরে পুরো টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যান হার্দিক ৷ সহ-অধিনায়ককে হারিয়ে চাপে ছিল দল ৷ এর ফলে দলের কম্বিনেশন পুরো বদলে যায় ৷ হার্দিকের চোটের জেরে দলে সমতা আনতে প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়েন শার্দূল ঠাকুর ৷ বদলে 6 নম্বরে সূর্যকুমার যাদবকে খেলানো হয় নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে লিগ ম্যাচে ৷ আর পঞ্চম বোলার হিসেবে মহম্মদ শামি ওই ম্যাচেই বিশ্বকাপের প্রথম একাদশে ঢোকেন ৷
আর এই বদল ভারতকে লাভবান করেছিল ৷ মহম্মদ শামি প্রথম ম্যাচেই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে কঠিন দল মনে হওয়া নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে 5 উইকেট তুলে নেন ৷ আর টুর্নামেন্ট শেষ হতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন শামি ৷ একার হাতে একাধিক ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটিংকে ধ্বংস করেছেন 'লালা' ৷ তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন জসপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজ, কুলদীপ যাদব এবং রবীন্দ্র জাদেজা ৷
শেষ লগ্নে স্বপ্নে উড়ানের পতন
সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে ধরাশায়ী করে ফাইনালে ওঠা ভারতকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ ছিল তুঙ্গে ৷ কিন্তু, যে কোনও আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া সবসময় আলাদা দল ৷ ক্রিকেট বিশ্বের এই প্রচলিত প্রবাদটিকে সত্যি করেন প্যাট কামিন্সরা ৷ তবে, অজিরা আমেদাবাদের পিচকে সঠিক চিনেছিল ৷ তাই টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন কামিন্স ৷ তবে, পুরো টুর্নামেন্টের মতো রোহিত তাঁর আগ্রাসন ছাড়েননি ৷ আর সেখানেই ভুল বাজি খেলে ফেলেন তিনি ৷ গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে উইকেট দিয়ে আসেন ৷ বিরাট এবং কেএল রাহুল চেষ্টা করলেও, তাঁরাও স্লথ উইকেটের কাছে হার মানেন ৷ মাত্র 240 রানে শেষ হয় ভারতের ইনিংস ৷
যে রান তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়াও শুরুতে ভেঙে পড়ে ৷ মহম্মদ শামি এবং জসপ্রীত বুমরার পেসের সামনে মাত্র 47 রানে 3 উইকেট হারায় অজিরা ৷ মনে হয়েছিল ভারতীয় দল 240 রানও ডিফেন্ড করতে পারবে ৷ কিন্তু, যত রাত বাড়তে থাকে, তত আমেদাবাদে আকাশে শিশিরের মাত্রা বেড়ে যায় ৷ আর তা পিচ ও মাঠে পড়তেই ব্যাটিং সহজ হয়ে যায় অজি ওপেনার ট্রাভিস হেড এবং মার্নস লাবুশানের জন্য ৷ হেড শেষ মুহূর্তে আউট হলেও, লাবুশান এবং ম্যাক্সওয়েল ম্যাচ শেষ করে ফেরেন ৷ সঙ্গে ভারতের বিশ্বজয়ের স্বপ্নের উড়ান ভূ-লুণ্ঠিত হয় ৷
আরও পড়ুন: