আর ৪ মাস পরেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ। কিন্তু, তার আগে ঘটে গেল এক লজ্জাজনক ঘটনা। বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত কলেজের বিধান সরণী ক্যাম্পাসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল বিদ্যাসাগরের মূর্তি। চলতি লোকসভা ভোটে বিভিন্ন দলের হিংসার কারণে এবার বলি হতে হল খোদ বিদ্যাসাগরকেই। অভিযোগ তোলা হয়েছে BJP-র দিকে। পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের রোড শো ছিল গতকাল। রোড শো থেকে বেরিয়ে নাকি এই কাণ্ড ঘটালেন দলের কর্মী সমর্থকরাই। মূর্তি ভাঙার ঘটনা নাকি ঘটেছে অমিত শাহের সামনেই। এই ঘটনা বাংলার ভাবাবেগকে গভীরভাবে আঘাত করেছে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিদ্বজ্জন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। সোশাল মিডিয়ায় চলছে ঘটনার তীব্র নিন্দা। ঘটনাকে ধিক্কার জানাতে পিছপা হয়নি টলিউডের বিখ্যাতরাও। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন ETV Bharat'কে।
এই মুহূর্তে মুম্বইতে রয়েছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। তাঁকে ETV Bharat'এর প্রতিনিধি যোগাযোগ করেন ফোনে। ফোন ধরেই গৌতম বলেন, "এই ঘটনা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। ভাবছি, বিদ্যাসাগর কী দোষ করলেন? বহুদিন আগে একবার বিদ্যাসাগরের গলা কাটা হয়েছিল। কী কারণে এবার তাঁর মূর্তি ভাঙা হল, আমি শুনে তো অবাক! সমাজ সংস্কারক ওরকম একজন মানুষ। আসলে যেটা সমস্যা হয়ে গিয়েছে, মানুষ ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে। অতীতকে ভুলে যাচ্ছে। যাঁরা আমাদের দেশের ভালো করেছিলেন, সমাজ সংস্কার করেছিলেন, তাঁদের কথা ভুলে যাচ্ছে বলেই এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। যিনি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছেন, তিনি হয়তো জানেনই না বিদ্যাসাগর কে?"
প্রবীণ পরিচালক তরুন মজুমদার বলেন, "কী বলব বলুন। এইসব দেখলে বড্ড খারাপ লাগে। সবচেয়ে বড় কথা এই বয়সে এসে, এইসব দেখতে হচ্ছে। আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে, এটা আমি জানতে চাই। আমাদের দেশের শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকেছে। মূর্তি ভাঙার আগে একবারও দেখল না, কার মূর্তি ভাঙছে। খুব লজ্জাজনক আর দুঃখজনক ঘটনা। ক্ষমতার লোভ আর ক্ষমতার প্রদর্শনে মানুষ এখন অন্ধ।"
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, "বিদ্যাসাগর আমাদের সমাজকে শুদ্ধ করেছেন। আমাদের শিক্ষিত করেছেন। এটাই এতদিন জেনে এসেছি। আজ যা দেখতে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমরা কোনও শিক্ষিত সমাজে বাসই করি না। আজ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে, কাল রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙবে, পরশু রামমোহনের মুক্তি ভাঙবে... এখন অন্ধকার সময়ের দিকে এগোচ্ছি।"
কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, "লজ্জা, লজ্জা। এটা আমাদের বাঙালির লজ্জা। আমাদের দেশের লজ্জা। আমাদের সমাজের লজ্জা। আমি বাকরুদ্ধ। এই ব্যাপারে কথা বলতে গেলে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে চাই না।"
কবি শ্রীজাতও একই কথা বললেন, "আমাদের সমাজের থেকে এই মুহুর্তের এর চেয়ে বেশি আমি আর কিছুই আশা করি না। আশা-প্রত্যাশা অনেককাল আগেই বন্ধ করে দিয়েছি। তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তিও যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, এতটা নিম্নতা প্রত্যাশা করিনি। একটা ভোটকে ঘিরে যে আর কী কী হবে, সেটাই ভাবছি।"
এই লজ্জাজনক ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি। তিনি বললেন, "এটা নিয়ে কথা বলার অনেক মানুষ আছেন। এটা ভালো না মন্দ, সেটা যদি মানুষ বুঝতে না পারে, সেটা তাঁদের বোঝানোর কোনও দরকার নেই। একটা কথাই বলতে চাই অসম্ভব নিন্দনীয় ঘটনার। বাঙালি হয়ে খুব লজ্জিত বোধ করছি।"
একই সুর শোনা গেল পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। বললেন, "এটা আমাদের সকলের লজ্জা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের জাতির গর্ব। তাঁর মূর্তি ভাঙা মানে বাঙালি অহমে আঘাত করা। বিষয়টা এত খারাপ লাগছে, যে বেশি কথা বলতে ইচ্ছেই করছে না।"