কলকাতা, 7 মার্চ : রাত পোহালেই 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস'। নারী জাতিকে সম্মান জানাতে সমাজে নারীর ভূমিকা, তাঁদের লড়াই, তাঁরা দশভুজা এহেন সব বক্তব্যে মুখরিত হবে মঞ্চ। নারীরা কী না পারে? তাঁরা পুলিশ হয়ে প্রশাসন সামলায়, পাইলট হয়ে প্লেন ওড়ায়, সিকিউরিটি গার্ড হয়ে রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকা পালন করে । তাঁরা সাংবাদিক, তাঁরা ডাক্তার, তাঁরা শেফ, তাঁরা ড্রাইভার তাঁরা আরও কত কী। কিন্তু এই কয়েকদিন আগেও তাঁরা পারত না শুধু পৌরহিত্য করতে । কারণ তাঁদের পৈতে হয় না । সেই না পারার জায়গাও পূরণ করে দিয়েছে মহিলা পুরোহিত দল 'শুভমস্তু'।
তাঁদের কর্মকাণ্ড ঘিরে তৈরি হয়েছে 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'-র বাংলা ছবিও । উল্লেখ্য, গত বছর দুর্গাপুজোতেও পৌরহিত্য করেছে 'শুভমস্তু' । এ বছর একটি সাংস্কৃতিক সংস্থায় সরস্বতী পুজোও করেছে 'শুভমস্তু'। নারীরা যখন নিজেদের জায়গায় এভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পূর্ণা তখন আলাদা করে ঘটা করে কি নারী দিবস পালনের কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে? এই প্রশ্ন সামনে রেখে 'শুভমস্তু'র অন্যতম সদস্যা তথা অধ্যাপিকা নন্দিনী ভৌমিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এই ব্যাপারে তাঁর কী মত?(Nandini Bhowmik speaks on the importance of International Womens day)
তিনি বলেন, "নারী দিবসের প্রয়োজন আছে । তাঁদের অস্তিত্বের লড়াই নিয়ে কথা বলারও প্রয়োজন আছে বৈকি । তবুও আমি চাই, এমন সমাজ তৈরি হোক যেখানে আর ৮ মার্চ উদযাপন করতে হবে না ।" নারী দিবসের প্রয়োজন থাকলেও তা নিয়ে যে ব্য়বসায়ীকরণ চলছে তাতে তাঁর তীব্র আপত্তি রয়েছে ৷ এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "এই ৮ মার্চ দিনটিকে ঘিরে ইদানিং যে ব্যবসায়িকরণ চলছে অর্থাৎ এই দিন গয়না কিনলে মেয়েদের জন্য ছাড় কিংবা অন্যান্য কেনাকাটায় ছাড় এগুলোতে আমার আপত্তি আছে । বরং সমাজের যে সব নারীর কাছে শহরের আলো পৌঁছয় না, সেই সব নারীরা যদি এই দিনটিতে বিশেষ কিছু সুযোগ, সুবিধা পান তা হলে তাঁদের কিছু উপকার হয় । এমনটা হলে বেশি খুশি হব আমি ।"
মহিলা পুরোহিতকে কেন্দ্রে রেখে সিনেমা তৈরি হলেও আজও তাঁদের এই কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারে না সমাজের বেশিরভাগ মানুষ । চলে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ । আবার অনেকে তাঁদের কর্মকাণ্ডকে কুর্নিশ জানিয়ে বাড়ির বিয়ে কিংবা পুজোতে পৌরহিত্য করতে ডাকে তাঁদের। এই ব্যাপারে নন্দিনী বলেন, "ব্যঙ্গ বিদ্রূপ পিছু ছাড়বে না আমাদের । এটা তো স্রোতের একেবারে উল্টোদিকে হাঁটা তাই বেগ পেতে হবেই । আগে আমাদের ডাকত না কেউ । আমরা আমাদের সাহস, দক্ষতা এবং অবশ্যই অনেক পড়াশুনা দিয়ে নিজেদের জায়গাটা তৈরি করেছি । পঞ্চকবি যে কথাগুলো লিখে গিয়েছেন গানের মাধ্যমে, সেগুলিই আমরা পরিবেশন করি । সেগুলো তো শুধু কথা নয়, সেগুলো মন্ত্র । আমাদের পৌরহিত্যে আধ্যাত্মিকতা এবং শিল্প মিলেমিশে থাকে । গানের মাধ্যমে আমরা মন্ত্র পড়ি । তাই কিছু মানুষের কাছে আমরা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি । অনেকে আবার আমাদের পছন্দ করছেন না । এটা মেনে নিতেই হবে আমাদের এবং আমরা মেনে নিই । তবে, সমাজে নতুন কিছু একটা তৈরি করতে পেরেছি এটাই বা কম কিসের? তৈরি হল তো একটা সিনেমা । কোনওদিন ভেবেছি যে আমরা দুর্গাপুজো করব? করলাম তো । আমরা বিভেদহীন সমাজ দেখতে চাই । আমরা মানবকল্যাণকামী ।"
আরও পড়ুন : আবেগি পোস্টে বাবা ভিভকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন মাসাবা
প্রসঙ্গত, সরস্বতী পুজোয় 'শুভমস্তু' বই, হারমোনিয়াম, ঘুঙুর, পেন, খাতা পুজো করে । এখন প্রশ্ন হল তাহলে কি 'শুভমস্তু' পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করে না? নন্দিনী ভৌমিকের উত্তর, "তা কেন? মূর্তি থাকলে কোনও আপত্তি নেই আমাদের । তবে, থাকতেই হবে এমনটাও নয় । আমরা মানুষের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবায় বিশ্বাসী । কিন্তু প্রতিমা ঘিরে মানুষের মধ্যে একটা ভাবাবেগ আছে । সেখানে আমরা আঘাত হানতে চাই না । দুর্গাপুজো করলাম তো । সেখানে তো মূর্তি ছিল । কোহিনুর সেন বরাটের সংস্থায় সরস্বতী পুজো করলাম সেখানেও বাগদেবীর মূর্তি ছিল ।" এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়, সমগ্র নারীজাতি তথা দেশের গর্ব গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয় নন্দিনী ভৌমিক, সেমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, রুমা রায় এবং পৌলমী চক্রবর্তী অর্থাৎ 'শুভমস্তু'র পৌরহিত্যে । ভারতের ইতিহাসে এও এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে রইল তা বলাই বাহুল্য ।