ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আক্রমণ আজ 36তম দিনে পড়ল (Russia-Ukraine War) ৷ কিন্তু ওই দেশে রুশ সেনা যেভাবে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, তা ভ্লাদিমির পুতিন আগে দেখেননি ৷ রুশ সেনাকে এই ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে, সেটাও মাসখানেক আগে ভাবাই যায়নি ৷ রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করে এবং ইউক্রেনের শহরগুলির দুর্দশা করার জেরে ওই দেশ যে সারা বিশ্ব থেকে এত সমর্থন পেয়ে যাবে, তাও পুতিন ভাবতে পারেননি ৷
রাশিয়ার এই ধরনের অভিযানের এই পরিণতি এই প্রথম হল না ৷ 1979 সালে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি সোভিয়েত সরকারকে জানিয়েছিল যে আফগানিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যতা বাড়ছে ৷ তাই আফগানিস্তানের সেই সময় যা ক্ষমতা ছিল, ওই দেশকে তার থেকেও বড় শত্রু হিসেবে ভেবে বসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ৷
তখনও আফগানিস্তানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সোভিয়েত সরকার ৷ তখনও এর প্রভাব মস্কোর উপর কী পড়তে পারে, তা আগে ভাবা হয়নি ৷ ওই হামলার জেরে রাশিয়ার শত্রুদের উপর পালটা আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল সোভিয়েতের শত্রুরা ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের পরিকল্পনা করে ৷ যাতে বিদ্রোহীদের কাছে হেরে গিয়েছে, এমনটা দেখিয়ে সোভিয়েতের মতো শক্তিধর দেশকে অপমানিত করা যায় ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই আফগানিস্তানকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে গোপনে সাহায্য করতে শুরু করে ৷ তাদেরকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে তারা সরাসরি সোভিয়েতের সঙ্গে সম্মুখসমরে নামতে পারে ৷ পাকিস্তানের সেনা ও আইএসআই, তাদের সব ক্ষমতা দিয়ে আফগান বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে শুরু করে ৷ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়, যাতে শরণার্থীদের সহজে বের হতে দেওয়া যায় এবং আফগান বিদ্রোহীদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায় ৷
‘আফগানিস্তান : দ্য বেয়ার ট্র্যাপ’ (Afghanistan The Bear Trap book) নামে একটি বই লিখেছিলেন মহম্মদ ইউসুফ ও মার্ক অ্যাডকিন ৷ সেই বইতে উল্লেখ রয়েছে যে কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে সাহায্য করেছিল ৷ পাকিস্তান ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে আফগানদের সাহায্য করেছিল ৷ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর লক্ষ্য ছিল আফগান যোদ্ধাদের সাহায্য করে সোভিয়েতকে দুর্বল করে দেওয়া ৷ রাশিয়ার সেনাকে পরাজিত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ৷
এর ফলে সোভিয়েত খুব বেশিদিন লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে পারেনি ৷ শেষ পর্যন্ত 1988-89 সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় ৷ মজার বিষয় হল, 2021 সালে সেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কার্যত মধ্যরাতে চলে যায় 20 বছর সেখানে থাকার পর ৷ এর থেকে বোঝা যায় যে রাশিয়া নিজেদের পুরনো ভুল থেকে কিছুই শিক্ষা নেয়নি ৷ এমনকী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 20 বছর আফগানিস্তানে থাকার পরও যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল, তার থেকেও তারা কিছু শেখেনি ৷ আফগান যুদ্ধের জন্যই ইউএসএসআর ভেঙে গিয়ে 15টি দেশের সৃষ্টি হয়েছিল ৷ তার মধ্যে একটি ইউক্রেন এখন রাশিয়ার সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করছে ৷
রাশিয়া আবার শত্রুর ছায়া দেখলে নিজের দরজায় ৷ আর তার জেরেই ইউক্রেনে আক্রমণ করে বসল ৷ ঘটনাচক্রে, ইউক্রেনে আক্রমণের সিদ্ধান্তের জেরে পুতিন যে ধাক্কা খেয়েছেন, তা তিনি যা আশা করেছিলেন, তার থেকেও বেশি৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের সখ্যতা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য় হওয়ার জন্য ইউক্রেনের আবেদনের জেরেই পুতিন ক্ষেপে গিয়েছিলেন ৷ যার জেরেই এই ইউক্রেন অভিযানের পরিকল্পনা করা হয় ৷ পুতিন ভেবেছিলেন যে এই অভিযান খুব সহজেই করা যায় ৷ কয়েকটি প্রতিবেদনেও প্রকাশ পেয়েছিল যে এই অভিযান তিনদিনেই শেষ হয়ে যাবে ৷ এই অঙ্ক মারাত্মক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে ৷ কারণ, প্রচুর ধ্বংস হয়েছে এবং সাধারণ নাগরিক ও সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে ৷ মৃত্যু ও ধ্বংস ইউক্রেনে অচলাবস্থা তৈরি করেছে ৷ যার জেরে প্রতিটি দিন যত যাচ্ছে, ততই ইউক্রেনের প্রতিরোধ শক্তি বাড়ছে ৷
1979 ও 2022 সালের দু’টি অভিযানকে যদি পাশাপাশি রাখা যায়, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে ইউক্রেনে রাশিয়ার ভাগ্য কী হতে চলেছে ৷ আফগান যুদ্ধ সোভিয়েতের সুনাম মারাত্মক ভাবে নষ্ট করেছিল ৷ আর ইউক্রেন যুদ্ধ একেই ভাবে পুতিনের জমানার উপর ঝুঁকি তৈরি করে দিল ৷ মঙ্গলবার (মার্চ 30) তুরস্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা হয় ৷ সেখানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে হামলার ঝাঁঝ কমানোর বিষয়ে সহমত হয়েছে রাশিয়া ৷ এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে পুতিন ভাবতে শুরু করেছেন, সহজে ইউক্রেন দখল সম্ভব নয় (Putin losing Ukraine war) ৷ সেই কারণেই তিনি ওই অঞ্চলে আক্রমণের তীব্রতা কমাতে চাইছেন ৷
কিন্তু পশ্চিম বিশ্বকে একটা কারণ, বলা ভালো অধিকার দিয়ে দিলেন তাঁকে কোণঠাসা করার জন্য৷ আর এখন ইউক্রেন থেকে সরে আসাই তাঁর কাছে একমাত্র বিকল্প ৷ অভিযান শুরুর সময় ইউক্রেনকে খুব নগন্য বলে মনে করা হয়েছিল ৷ কিন্তু তারা এখন পূর্ব ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে উঠে এল এবং আগামিদিনে রাশিয়ার কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল ৷
ইউক্রেনের বাসিন্দারা যেভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লেন, সেটাই ওই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে দাঁড়াল ৷ ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা যাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলিতে যাচ্ছেন, তাঁদের সহানুভূতির সঙ্গে সাহায্য করা হচ্ছে ৷ ঠিক যেমন আফগানরা পাকিস্তান, ভারত ও অন্যত্র সাহায্য পেয়েছিলেন ৷ শরণার্থী যত বাড়বে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং ইউক্রেনে রুশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তত বৃদ্ধি পাবে ৷
ইউক্রেনের যোদ্ধারা তাঁদের ভিত শক্ত করে নিলেন ৷ আর ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী তৈরি করার জন্য সাহায্য পেয়ে যাবে ৷ ইউক্রেনের যে অংশগুলিতে রাশিয়া বিদ্রোহীদের ইন্ধন দিচ্ছিল, তা ক্রমশ মস্কোর মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠছিল ৷ যুদ্ধের জেরে যে পট পরিবর্তন হল, তাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরও বাড়বে ৷ এমনকী, রুশ ভাষায় যে জায়গার মানুষ কথা বলেন, সেখানেও পুতিনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়তে শুরু করেছে ৷
রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব এবং সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যুই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় সহযোগীদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ৷ পুতিনকে নিজের দেশেই শত্রু হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং সেখানেই তাঁকে ঘৃণা করা হচ্ছে ৷ আর এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, কোনও শক্তিশালী দেশই আর সহজেই কোনও ছোট্ট দেশের উপর আক্রমণের কথা ভাববে না ৷
আরও পড়ুন : Russia-Ukraine Conflict : তাহলে কি যুদ্ধের ইতি ? কিভ থেকে বড় সংখ্যায় সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত রাশিয়ার