নয়াদিল্লি, 18 অক্টোবর: ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাত মাঝমধ্যেই অশান্তির আকার নেয় ৷ হামাস এবং ফাতাহ ইজরায়েলের প্রধান দু’টি সত্তা ৷ যারা নিজেদেরকে রাজনীতি, ক্ষমতা ও আদর্শের জটিল জালে আটকে রেখেছে । গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে তাদের নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৷ এর ফলে এই দলগুলো শুধু প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং ঐক্যের জন্য একটি অবিরাম চ্যালেঞ্জও তৈরি করে ।
ফাতাহ একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী সংগঠন, যা ঐতিহাসিকভাবে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র অর্জনের জন্য ইজরায়েলের সঙ্গে আলোচনার পক্ষে । এরা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাস করে । বিপরীতে, হামাস একটি ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, যারা সশস্ত্র প্রতিরোধের পক্ষে এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হিংসায় জড়িত । এরা প্যালেস্টাইনের পূর্ণ স্বাধীনতার সমস্ত বিকল্পকেই প্রত্যাখ্যান করেছে ।
ফাতাহ আগে ছিল প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট নামে ওই দেশের একটি জাতীয়তাবাদী ও সামাজিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল । এটি কনফেডারেটেড মাল্টি-পার্টি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর বৃহত্তম দল এবং প্যালেস্টাইন লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের (পিএলসি) দ্বিতীয় বৃহত্তম দল । ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফাতাহর চেয়ারম্যান ।
ফাতাহ 1959 সালে ফিলিস্তিনি প্রবাসী সদস্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৷ মূলত, পারস্য উপসাগরীয় দেশে কর্মরত পেশাদার যারা কায়রো বা বেইরুটে পড়াশোনা করেছিলেন এবং গাজায় শরণার্থী ছিলেন, তাঁদের দ্বারাই আন্দোলন শুরু হয় । প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ইয়াসির আরাফাত, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল ইউনিয়ন অফ প্যালেস্টাইনিয়ান স্টুডেন্টস (জিইউপিএস) এর তৎকালীন প্রধান, সালাহ খালাফ, খলিল আল-ওয়াজির এবং বেইরুটের তৎকালীন জিইউপিএস প্রধান খালেদ ইয়াশ্রুতিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । ফাতাহ একটি ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আদর্শকে সমর্থন করে, যেখানে ফিলিস্তিনি আরবরা তাদের নিজস্ব কাজের দ্বারা স্বাধীনতা পাবে ।
আরও পড়ুন: গাজার হাসপাতালে হামলায় ইজরায়েল জড়িত নয়, দাবি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের
প্রথম ইন্তিফাদা (ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ) শুরু হওয়ার পরপরই মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসাবে হামাস 1987 সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । এটি একটি ফিলিস্তিনি সুন্নি-ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন ৷ এই সংগঠনকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বেশ কয়েকটি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে গণ্য করে ৷
কিছু প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়েছে যে ফাতাহ-এর প্রতিপক্ষ হিসেবে হামাসকে উৎসাহিত করার পিছনে ইজরায়েলের হাত ছিল । 2018 সালে দ্য ইন্টারসেপ্টে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় হামাস তৈরি নিয়ে ৷ যা লিখেছিলেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সম্প্রচারকারী মেহেদি হাসান ও মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক দিনা সৈয়দ আহমেদ ৷ সেখানে হামাসের সৃষ্টির নেপথ্যে ইজরায়েল কীভাবে জড়িত, তা ব্যাখ্যা করা হয় ৷
সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়, "এটি একটি ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব নয় ৷ প্রাক্তন ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কথা শুনুন ৷ যেমন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইতজাক সেগেভ, যিনি 1980-এর দশকের শুরুতে গাজায় ইজরায়েলি সামরিক গভর্নর ছিলেন । সেগেভ পরে নিউইয়র্ক টাইমসের একজন প্রতিবেদককে বলেছিলেন যে তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন এবং ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ পার্টির ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং বামপন্থীদের জন্য 'কাউন্টারওয়েট' হিসাবে ফিলিস্তিনি ইসলামী আন্দোলনকে অর্থ যোগাতে সহায়তা করেছিলেন ৷’’ উল্লেখ্য, ইয়াসের আরাফাত হামাসকে ইজরায়েলের তৈরি বলে দাবি করেছিলেন ৷
2004 সালের নভেম্বরে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর 2005 সালে ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে । 2006 সালের 25 জানুয়ারি আইনসভার নির্বাচনে হামাস বিজয়ী হয়েছিল ৷ তার পর থেকেই উপদলীয় লড়াই শুরু হয় ৷ দুই দল সরকারি ক্ষমতা ভাগাভাগি করার জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে বারবার ব্যর্থ হয় ৷ তার পরে এই লড়াই আরও তীব্র হয়ে ওঠে ৷ 2007 সালের জুন মাসে হামাস গাজা দখল করে নেয় । এর আগে 2005 সালে তৎকালীন ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন বিতর্কিতভাবে গাজার 21টি বসতি এবং উত্তর পশ্চিম তীরের চারটি বসতি থেকে 9,480 জন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীকে বিতাড়িত করেন ।
আরও পড়ুন: ইজরায়েলের উপর আক্রমণ, হামাসের বিরুদ্ধে নিন্দা-প্রস্তাব রাষ্ট্রসংঘের
এখন ফাতাহ ওয়েস্ট ব্যাংকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধান এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তখন হামাস গাজার প্রকৃত শাসক । এই অঞ্চলের সমস্যাগুলির সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র ইটিভি ভারত-কে জানিয়েছে, হামাস যখন 2007 সালে ক্ষমতায় আসে, তখন ইজরায়েলের উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল ৷ কিন্তু ইজরায়েল যা বুঝতে পারেনি যে তারা নিজের একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছে ।
এদিকে হামাস ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ে, কারণ তারা নিজেকে কেবল গাজা উপত্যকায় সীমাবদ্ধ বলে মনে করে । ইজরায়েল এবং পিএলও-এর মধ্যে এক জোড়া চুক্তি হয়েছিল ৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল ৷ তারা ওয়েস্ট ব্য়াংক ও গাজা উপত্যকার কিছু অংশে ফিলিস্তিনি স্ব-শাসন পরিচালনার দায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল । পরে সেই অসলো চুক্তি ব্যর্থ হয়৷ তার পর ইজরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের জেরে তৈরি ইস্যুগুলির বিষয়ে ইজরায়েলের সঙ্গে পিএলও-র আলোচনা হত৷ সেটা হামাসের হতাশাকেও আরও বাড়িয়ে দেয় ।
চুক্তির অনুযায়ী, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তার বিষয়ে ইজরায়েলি দখলদারিত্ব এবং ইজরায়েলিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যেকোনও সশস্ত্র প্রতিরোধের আক্রমণের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে । এটিকে অত্যন্ত বিতর্কিত হিসাবে দেখা হয় এবং কেউ কেউ একে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দ্বারা ইজরায়েলি দখলদারির সঙ্গে সহযোগিতা বলেও মনে করে ৷ প্রেসিডেন্ট আব্বাস নিয়মিত এবং প্রকাশ্যে ইজরায়েলিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দ্বারা পরিচালিত সশস্ত্র প্রতিরোধের যেকোনও অভিযানের নিন্দা করেন ।
একটি সংকীর্ণ ভূমিতে সীমাবদ্ধ থাকায় গাজার ফিলিস্তিনিরা জীবন পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণরূপে বাইরের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল । হামাস রাষ্ট্রসংঘের সাহায্যকারী সংস্থাগুলোকে গাজায় কাজ করার অনুমতি দিয়েছে ৷ এই সংস্থাগুলো সেখানে স্কুল ও হাসপাতাল খুলেছে । গাজার জনগণ বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল ।
আরও পড়ুন: ইজরায়েলের পাশে থাকতে ভূমধ্যসাগর সামরিক শক্তিবৃদ্ধি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, হামাস ইজরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে শুরু করেছে, যারা তাদের সাহায্য পাওয়া বন্ধ করে দেবে । মিশরের সঙ্গে বিশেষ করে দক্ষিণে রাফাহ ক্রসিং নিয়েও এর সমস্যা রয়েছে । মিশর চায় না ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূখণ্ড অতিক্রম করুক । কায়রো হামাসকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্লোন বলেও মনে করে । এই সবের ফলে গাজার মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ বাড়তে থাকে এবং হামাস জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
ওই সূত্রের ব্যাখ্য়া, এমনকী ওয়েস্ট ব্য়াংকেও অসলো চুক্তি, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ এবং ইহুদি বসতিগুলির মতো ইস্যুতে ফাতাহের ব্যর্থতার কারণে হামাস জনগণের কিছু অংশের মধ্যে সমর্থন পেয়েছে । রামাল্লা, ওয়েস্ট ব্য়াংক-ভিত্তিক কর্মী হাজেম আবু হেলালের মতে, হামাসের একটি স্বতন্ত্র মতাদর্শ রয়েছে এবং তাদের কাছে তাদের ধারণা প্রচারের জন্য কাজ করে, এমন লোক রয়েছে ৷ আর ফাতাহ তাদের অনুগামীদের সুরক্ষিত করার জন্য অর্থ ব্যবহার করে ।
আবু হেলালকে আল জাজিরা বলেছে, “আজ আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করেন, তাদের অধিকাংশই জানেন না ফাতাহের আদর্শ কী । আন্দোলনের সুস্পষ্ট নীতি নেই৷” কয়েক বছর ধরে, একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি সরকার গঠনের জন্য ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে সমঝোতার বিভিন্ন প্রচেষ্টা হয়েছে । এই প্রচেষ্টাগুলি আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে৷ কিন্তু তারা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হয়নি ৷ ঐক্য না হওয়ার জন্য উভয়পক্ষই একে অপরকে অভিযুক্ত করেছে ৷
সামগ্রিকভাবে, হামাস ও ফাতাহর মধ্যে একটি জটিল এবং প্রায়শই প্রতিকূল সম্পর্ক রয়েছে, যা রাজনৈতিক পার্থক্য, ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা এবং মাঝে মাঝে এক হওয়ার প্রচেষ্টা দ্বারা চিহ্নিত । ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের প্রতি তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বহু বছর ধরে ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে উত্তেজনার কারণ হয়ে রয়েছে ।
আরও পড়ুন: গাজার হাসপাতালে ভয়াবহ হামলা! শর্তসাপেক্ষে বন্দিদের মুক্তি দিতে আগ্রহী হামাস